মানুষের চিন্তাজগতে বিজ্ঞানের প্রভাব ক্রমশ বেড়ে চলেছে।আর এর সাথে সাথে বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানুষের চিন্তাধারার পরিবর্তনকে তরান্বিত করছে।এক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের বিরোধটা খুবই প্রত্যাশিত।কারণ, বিশ্বাস হচ্ছে ধর্মের দার্শনিক ভিত্তি ।ধর্মের সকল বিষয় এই বিশ্বাসকে ঘিরেই আবর্তিত হয়।আর বিজ্ঞানের দার্শনিক ভিত্তি হচ্ছে অবিশ্বাস।সংশয় পোষণ করাই এর মূল কথা।তাছাড়া সার্বিক ভাব-চিন্তার প্রেক্ষিতে বিশ্বাসের সাথে সংশয় একদম যায় না।আর উভয়টিই মনোজাগতিক ব্যাপার।সুতরাং মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রে আপনাকে,আমাকে যেকোন একটিই গ্রহণ করতে হবে।কেননা জগতের জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াইয়ে ঠিকে থাকতে হলে;আপনি,আমি কোন পক্ষের লোক সেটা স্পষ্ট করা খুবই জরুরি।১২/১০/২০১৭ইং
Translate
Monday, 3 December 2018
মুক্তবুদ্ধি
Saturday, 10 November 2018
বুদ্ধিজীবী!
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নব্য-বুদ্ধিজীবিদের নৈতিক অবস্থান ও সমর্থনের যে ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের প্রতিবাদের যে ভাষিক রূপ দেখতে পাচ্ছি, তার সাথে আমাদের দেশের কথিত বুদ্ধিজীবিদের সার্বিক অবস্থানের বিষয়টিকে বিবেচনা করলে, আক্ষরিক অর্থে 'বুদ্ধিজীবি' পরিচয়টিকে যথেষ্ট ছোট করা হয় । কেননা ঐসব কথিত বুদ্ধিজীবিরা ব্যক্তিগত সংকট-সংঘাত-সমস্যার কাছে মাথানত করে ক্ষমতার প্রতি সত্য ভাষণের আদর্শিক-যৌক্তিক লড়াই করার সৎ সাহস-শক্তিটুকু ইতোমধ্যেই হারিয়ে ফেলেছেন ।তাই তো এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীনদের এমন 'অগণতান্ত্রিক' ক্ষমতার ব্যবহার দেখেও দিব্যি তারা তাদের মৌনব্রত পালন করে চলেছেন।সে হিসেবে নব্য-বুদ্ধিজীবিরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের মত মানবিক এবং অরাজনৈতিক একটি ইস্যুতে উল্টোমুখো গণমাধ্যম ও ক্ষমতাসীন দলের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছাত্র-সমাজের ক্ষমতাবিরোধী প্রতিবাদের সাথে সংহতি জানিয়ে যে বুদ্ধিজীবিতার পরিচয় দিচ্ছেন, নিজেদের 'উপলব্ধিযোগ্য অস্তিত্ব'র উপস্থিতির জানান দিচ্ছেন, বুদ্ধিজীবির পরিচয় সাপেক্ষে তাঁদের এই অবস্থান প্রশংসনীয়!০১/০৭/২০১৮ইং
Saturday, 3 November 2018
চক্র
বাইরে বের হওয়াটা এত সহজ না, যত সহজে ফিরে আসা যায় তারচেয়েও কঠিন মনে হয় রহিমুদ্দির কাছে প্রতিদিন একই সময়ে একই কাজের উদ্দেশ্যে নিয়ম করে বাইরে বের হওয়াটা,যদিওবা পেটের দায় থেকেই এমনটা করতে হয় প্রতিদিন অনেক লোকের,সে হিসেবে বিষয়টাকে সে একপক্ষীয়ভাবেও ভাবতে পারে না, তারপরও কি এক যান্ত্রিক উপায়ে কাজটা তার রোজ করে যেতে হচ্ছে,ভেবে কূল পায় না রহিমুদ্দি,হয়তো তার মত আরো অনেকেই, হয়তো কোন একদিন এই পাকচক্রের মোহ কিম্বা মায়া কাটাতে না পেরে আত্মহত্যার মত পাপ কাজ করে বসবে সে,কে জানে?কখনো কখনো এসব ছাইপাশ ভাবতে ভাবতে ছমিরনের মুখটা ক্ষণিকের জন্য ডুবোচরের মত ভেসে উঠে । রহিমুদ্দি তখন আরো আনমনা হয়ে যায় । হঠাৎ একসময় তা হারিয়ে যায় । রহিমুদ্দিও সংবিৎ ফিরে পেয়ে নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে আগের মতো!যেন কিছুই হয়নি ।'চক্র' গল্পের অংশবিশেষ।
Thursday, 1 November 2018
মধ্যপাঠে...
অ্যাডাপ্টেড এক ডাচ্ যুবকের নিজের শিকড়ের প্রতি যে টান ; তার মর্মস্পর্শী আখ্যান-ই 'বারে বারে ফিরে আসি'-এর মূল উপজীব্য বিষয় ।
মানিক ওরফে মাইকেল বাংলাদেশে এসেছিল ঘুরতে । তার পালক ডাচ্ বাবা-মা'র কাছ থেকে সে জেনেছিল এই বাংলাদেশ থেকেই ছোটবেলায় তাকে হল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ।
তার আসল বাবা-মা'র কাছ থেকে চুরি করে ডাচ্ এনজিও কি তাকে তার ডাচ্ বাবা-মা'র হাতে তুলে দিয়েছিল নাকি তার হতদরিদ্র আসল বাবা-মা নিজেই তাদের শিশুপুত্রকে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল এ নিয়ে মাইকেলের সন্দেহ আছে ।
তারপরও কি এক অনুভূতি থেকে তার মধ্যে এই বোধ কাজ করে যে, তাকে চুরি-ই করা হয়েছে । আবার কখনো কখনো এ বিষয়ে তার মধ্যে মিশ্র অভিমান কাজ করে, তার মনে হয় তার বাবা-মা এ কাজ ইচ্ছে করেই করেছে ।
যখন চরম হতাশা আর ক্লান্তি লাগে এসব বিষয়ে, তখন নিজেকে তার বিপন্ন মনে হয় ।
জাতীয় দৈনিকের এক সাংবাদিকের বয়ানে কাহিনি এভাবেই এগুচ্ছে...
Thursday, 16 August 2018
কোলাহলে
এরপর তারা ঝড়ের মাঝে বেরিয়ে যেত । আমের ডাল ভেঙ্গে পড়ছে পথের ক্ষণে ক্ষণে আকাশ ডাকছে গুড়ুরগুড়ু, সুঁই সুঁই বৃষ্টি মাথায় নদীর পাড়ে গিয়ে পৌঁছুত তারা । মাইল মাইল লম্বা নদীর হুহু ফাঁকা পাড়, তীরের গাছপালা কাঁপছে আর করছে নাচানাচি ।কামরুল ভাই নদীতি নামবা?পাগলে ধরিসে? এন্নে নামলে পানিতি, টাইনে কুথায় নিয়ে চইলে যাবে আমাইগে জানিস?নিলিই তো ভাল ।
'কোলাহলে'র ফ্ল্যাপের এই অংশটুকু রোমান্টিক একটি কাহিনির দিকে ইঙ্গিত করে । একইসাথে চরিত্রের সংলাপ ও পরিবেশ এর গ্রামীণ পটভূমিতে লেখার কথাও জানান দেয় আমাদের ।
কিন্তু পাঠ শেষে এই উপন্যাসের কাহিনিকে ঠিক রোমান্টিক বলা যায় না । যদিও কামরুল আর রোকেয়ার মধ্যে প্রেমঘটিত একটা সম্পর্ক ছিল ।
সেটা কি একপক্ষীয় প্রেম নাকি দ্বিপক্ষীয়?
এমন একটা প্রশ্ন যদিওবা থেকে যায় । তারপরেও শেষপর্যন্ত মীমাংসায় পৌঁছুতে পারি না ।
এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে আরো কিছু রোমান্টিক চরিত্র আছে । উপন্যাসে সেগুলোর প্রত্যক্ষ কোন আবেদন না থাকলেও রোমান্টিক আবহ তৈরির ক্ষেত্রে এগুলোর পরোক্ষ কিছু অবদান আছে বৈকি ।
পুবপাড়া কে কেন্দ্র করে এই উপন্যাসের কাহিনির বিস্তার, যাতে গ্রামীণ জনজীবনের রূঢ বাস্তবতা, একইসাথে বৈচিত্র্যপূর্ণ সব চরিত্রের গ্রাম্য সরলতার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ আর একটি অযাচিত হত্যাকান্ডের রহস্য ক্রমশ উম্মোচিত হয়েছে পাঠকের সামনে ।
এই হত্যাকান্ডের রহস্যজট আরো ঘনীভূত হয় যখন চেয়ারম্যান আলাল শেখের শালা মনজু নিখোঁজ হয় । যার সাথে চেয়ারম্যান আলাল শেখ ও মনজুর স্ত্রী হালিমার গোপন সম্পর্কের একটা যোগসূত্র আছে ।
ঘটনার ঘনঘটার সাথে মানবিক স্খলন আর মানুষের আদিম প্রবণতায় যে বহুমূখী উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল একসময়, একের পর এক ফ্ল্যাশব্যাকের কারণে সেটা অনেকটা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, আর একইসাথে কাহিনিও তার গতি হারিয়েছিল; পাঠের মাঝে তেমনটাই মনে হয়েছে আমার ।
এই উপন্যাসে কতোরকম বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রের সাথে যে দেখা হয়ছে গল্পের বাঁকে বাঁকে,তার কোন হিসেব নেয়।চরিত্র নির্ভর এই উপন্যাসে সেসব চরিত্রের জীবনচিত্র আলাদা আলাদাভাবে বিকাশের দাবি করলেও এর অন্তিম পরিণতি গল্পের মতো হওয়ায় তেমনটা করা সম্ভব হয়নি হয়তো । যার কারণে গলাকাটা লাশের রহস্যজট উপন্যাসের শেষে খুললেও সেসব চরিত্রের যাপিত জীবনের পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাঠ শেষে পাওয়া যায়নি । এক্ষেত্রে লেখকের স্বীকার্যটি গুরুত্বপূর্ণ । ভূমিকাতে তিনি বলেছেন- 'চরিত্রগুলো আরও একটু বিকাশের দাবিদার ছিল,উপন্যাসটির পটভূমি পুবপাড়াও চাইছিল তাকে আরও খানিক পরিষ্কার (ঘোলাটে?) করে তুলিনা কেন?'
গ্রামীণ পটভূমিতে লেখা এই উপন্যাসে গ্রাম্যতাকে লেখক যেভাবে চিত্রিত করেছেন, অর্থাৎ এই উপন্যাসের চরিত্র, ভাষা, সংলাপের ব্যবহার, আবহ ইত্যাদি সবকিছুই এই উপন্যাসকে বিশিষ্টতা দান করেছে ।
যদিও লেখক চাইলে উপন্যাসের চরিত্রদের জীবনবোধ নির্মাণে আরো বিস্তৃত গল্পকে ধারণ করতে পারতেন । তাঁর গ্রাম্য জীবনবীক্ষণকে, সমাজবীক্ষণকে আরো স্পষ্ট, আরো অর্থবহ এবং আরো তাৎপর্যপূর্ণ করতে পারতেন!
বই সম্পর্কে~
নাম-কোলাহলে
লেখক-এনামুল রেজা
প্রচ্ছদ-শতাব্দী জাহিদ
প্রকাশক-আদী প্রকাশন
মূল্য-২০০ টাকা
Sunday, 8 July 2018
বর্ষামঞ্জরি
এই উপন্যাস যখন পড়তে শুরু করি, তখন প্রকৃতি কেমন ছিল?
'বর্ষামঞ্জরি' পড়তে শুরু করি বৃষ্টিমুখর বিষণ্ন এক বিকেলে ।
শুধুমাত্র একটি উপন্যাস পাঠে প্রকৃতির মলিন-বিষাদগ্রস্থ এমন একটি দিনও যে এতোটা মায়াময় আর স্নিগ্ধ হয়ে উঠতে পারে, মুগ্ধতা আর পার্থিব আচ্ছন্নতার মিশেলে কোমল একটি পরিবেশের সৃষ্টি করতে পারে, সেটা ভেবে অবাক হয়েছি । মন্ত্রমুগ্ধের মতো একনাগাড়ে পুরোটা পড়ে শেষ করেছি ।
প্রচ্ছদপাঠের প্রতিক্রিয়া কী?
বইটি হাতে নেওয়ার পর প্রচ্ছদেই চোখ আটকে গিয়েছিল।নারীমূর্তি,ধনুর্বিদ,মৎস্য আর সাথে বেলী ফুলের ছবি।এগুলো দেখে প্রথমে কোন কূল-কিনারা করতে পারিনি!
মহাভারতের অর্জুনের কথা মনে পড়ে হঠাৎ ।
দ্রৌপদীর স্বয়ংবর অনুষ্ঠানে সন্ন্যাসী অর্জুনের লক্ষভ্যেদী তীর নিমেষেই যখন মৎস্যের চক্ষুকে ভেদ করে চলে যায়,চারদিক থেকে তখন হরেক রকমের ফুলের বর্ষণ শুরু হয়।নানা বর্ণের,নানা গন্ধের সেইসব ফুলের মধ্যে হয়তো বেলী ফুলও ছিল! কে জানে...
প্রচ্ছদ পড়ে এমনটি-ই মনে হয়েছিল প্রথমে,এমনকি পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্রগুলিকে জীবন্তও মনে হয়েছিল! যেনবা চোখের সামনেই।আর উপর থেকে যে বেলী ফুলের বর্ষণ।থোকা থোকা বেলী ফুল।আহা! বুঝিবা রাজকুমারী বর্ষাঞ্জলির স্বয়ংবর অনুষ্ঠানের সেই অলৌকিক বর্ষণ।
আমি কেমন পাঠক?
আমি গল্প বলতে ভালবাসি।শুনতেও ভালবাসি।যখন কোন বই পড়ি, তখন কখনো গল্প বলিয়ে রূপে কিম্বা কখনো কখনো একজন নির্বাক শ্রোতা রূপে গল্পের চরিত্রদের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করি।
উপন্যাসের কাহিনীটা কিরকম?
এবং এর মাঝামাঝি এসে কি মনে হয়েছিল?
একজন গল্পকথক।যে কিনা কোনোরকম স্বার্থ ও উদ্দেশ্য ছাড়াই গ্রামে-গঞ্জে,শহরে-মফস্বলে ঘুরে ঘুরে লোকদের শুধু গল্প শোনায়।হরেক রকম গল্প।পাওয়া আর না পাওয়ার গল্প,বলা আর না বলার গল্প।যে গল্পে মূর্ত হয়ে আমাদের নাগরিক জীবনের সফলতা আর ব্যর্থতার ইতিবৃত্ত।একই সাথে ব্যক্তি থেকে শুরু করে সামাজিক-রাজনৈতিক রাষ্ট্রীয় বিষয়াবলিও।
গল্পের আসরে এই গল্পকথকের সাথে তার শ্রোতারাও আবার সমান গুরুত্বপূর্ণ।সবাই মুক্ত-মতামত জানিয়ে নিজেরদেরকে আরো গল্পের সাথে জুড়ে দিতে চাই।সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।বিচিত্র সব মানুষের সেইসব বৈচিত্র্যপূর্ণ মন্তব্য যেনবা বহুচিন্তার মানুষদের চিন্তাগত সহাবস্থানের এক অলৌকিক ইঙ্গিত! বুঝিবা সমাজের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের শিকড়ের গভীরতার পরিমাপ! যার অন্তিম পরিণতি গল্পকথকের হাতেই লেখা হয়।
উপন্যাসের পরিণতি নিয়ে আগ্রহ কেমন ছিল?
কোন বিষয়টি আমার কাছে আশ্চর্যজনক মনে হয়েছে?
গল্পকথকের গল্পই আমার আকার্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল,অন্তত গল্পের শেষের সেই করুণ অথচ ঘোরলাগা সময়ের চিত্র অবলোকন করার আগমূহুর্ত পর্যন্ত। স্বয়ংবর অনুষ্ঠানের বিচিত্র সব মানুষের সমাগমে রাজকুমারী বর্ষাঞ্জলির সেই মহৎ প্রাণের চিকিৎসকের গলায় মালা পরানোর সম্ভাব্য পরিণতি যতটা না কাঙ্খিত ছিল,গল্পকথকের উপস্থিতি তার চেয়েও বেশি চমকপ্রদ ছিল,সেই অলৌকিক ঘটনার জন্যে নয়,বরং শেষ মূহুর্তে গিয়ে গল্পকথকের নিজেই নিজের গল্পের চরিত্র হয়ে উঠার জন্য।
লেখকের লেখার সাথে আমার বোঝাপড়া কেমন?
লেখকের এই জাদুবিস্তারি গদ্যভঙ্গির সাথে আমার পরিচয় হয় দুই-তিন বছর আগে । তাঁর উপন্যাস 'অন্য কোথাও অন্য কোনখানে'র মধ্য দিয়ে । সেই যে মোহগ্রস্থ হয়েছি, এখনো সেই মোহ কাটে নি । দিন দিন সেটা বেড়েই চলেছে ।
পাঠ শেষে তীব্র আবেগের সাথে 'বর্ষামঞ্জরি' কে জড়িয়ে ধরি। যেন সমস্ত ভালোলাগা ক্ষনিকের জন্য হলেও একাকার হয়ে যায় । আর ঘোরগ্রস্থের মতো ভাবতে থাকি, এ কেমন উপন্যাস?
কিন্তু ভাবনা শেষ হয় না ।
এই ভাবনা শেষ হওয়ার নয় । কারণ এই ভাবনা যে অসীম!
আর একে পাড়ি দেওয়ার ক্ষমতা কি আদৌ আমার আছে...
আর কিছু বলার আছে?
হুম,আছে ।
আমি মনে করি, কেউ যদি বাংলাদেশকে জানতে চাই, এদেশের মানুষকে জানতে চাই; তাহলে তার এই উপন্যাস পড়া উচিৎ!
পুনশ্চ - এটি এই উপন্যাসের সামগ্রিক মূল্যায়ন নয় ।
বই সম্পর্কে~
নাম-বর্ষামঞ্জরি
লেখক-আহমাদ মোস্তফা কামাল
প্রচ্ছদ-শাহীনুর রহমান
প্রকাশক-শুদ্ধস্বর
মূল্য- ১৮০ টাকা
Wednesday, 27 June 2018
আত্মগীতি
এক.
সমাজের শিকড়হীন মানুষদের মাঝে নিজেকে একটা আপদমস্তক শিকড় বলেই মনে হয় আমার । যে আমি বটবৃক্ষের শিকড়কে বিস্তার করেই চলেছি । ইদানিং যেখানেই শিকড়কে মাটির গভীরে বিস্তার করতে গিয়েছি সেখানেই দেখি, মাটিগুলো নরম হয়ে আসছে । আর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি, প্রোথিত শিকড়গুলোও আগের মতো মাটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেই ।
ক্রমশ ঢিলে হয়ে আসছে; চারিদিকে যেন জল থৈ থৈ!
দুই.
আমার এই শিকড়; বইয়ের শিকড়!
বইপড়ার জাগতিক কোন লাভজনক দিক আপাত দৃশ্যমান হয়নি বলেই 'জন্মসূত্রে'র উদ্ধত খড়গ বহুমাত্রিক অপমান হয়ে হাজারো বৈষয়িক যন্ত্রণায় দগ্ধ মস্তিষ্ককে বার বার আঘাত করে চলেছে । যার ক্ষরণটা হচ্ছে শুধু হৃদয়ে । যা কেউ জানে না । হয়তো কোনদিন কেউ জানবেও না!
তিন.
কোথাও কোন আয়োজন নেই আমার এই বইপড়া নিয়ে । বাকিসব আয়োজন ঠিকই আছে!
অথচ কেউ জানবেনা বই পড়ে কি ক্ষতি হয়েছে আমার,তারা যে শুধু লাভটুকুই চাই!
সুধীজন বলেন, বই পড়লে মাথা খোলে । অথচ আমি নাকি কেবল অথর্ব-অপদার্থ এক নিঃসঙ্গ কীটে পরিণত হয়েছি । যার চেয়ে ঐ চটপটে হুজুগে ছেলেটাই নাকি ভাল ছিল, যে কিনা সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলত ।
আবার বলছেও যাচ্ছেতাই, বই পড়ে দিন দিন নাকি গন্ডমূর্খ হচ্ছি!
চার.
প্রবহমান ঘটনার স্রোতে বয়ে চলা এই পৃথিবীর তাবৎ ঘটনার মধ্যে আমার বইপড়ার বিষয়টি খুবই গৌণ ।
তথাপি আমি জ্বলন্ত সিরিয়ার আগুনের সংবাদ আর তার ইন্ধনের ইতিহাস এই বইয়েই পড়েছি । আর ফিলিস্তিনের গণমানুষের উপর ইহুদীদের রাষ্ট্রিক-সামরিক জাতিগত নিপীড়নের খবর পেয়েছি মাহমুদ দারবিশের কবিতায়, ঐসব উল্টোমুখো গণমাধ্যমের বিপরীতে দাঁড়িয়ে!
পাঁচ.
ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশকে নিয়ে গণমাধ্যমের যে রাজনীতি, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে তাদের যে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ, একইসঙ্গে একটি দেশ কিংবা একটি পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেওয়ার কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেওয়ার যে অনৈতিক প্রবণতা, তার শৃঙ্খলিত ইতিহাসকে, একইসাথে তার সাম্রাজ্যবাদী আচরণকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করার দায় এবং এর (আপাত) যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জেনেছি এডওয়ার্ড সাঈদের বই পড়ে; যে দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে দিয়েছে নতুন পথের দিশা, যেটা আর কেউই আমাকে দেখাতে পারে নি ।
তারপরও আমার বইপড়া কিংবা বই সংগ্রহ করা নিয়ে আমাকে সবসময় একধরনের ডিপ্রেশনে থাকতে হয় । অনেক সমীকরণ মেলাতে হয়!
ছয়.
প্রেমের ঐন্দ্রজালিক উৎসের সন্ধান আমি বইয়েই পেয়েছি । এবং এর বহুমাত্রিক প্রকাশ যে মানুষের মনে কতো রকমের প্রভাব ফেলে; একই সাথে কৈশোরের দ্বিধা-ভয় মিশ্রিত অনুভূতিগুলো কিভাবে যাপিত জীবনের স্মৃতি মন্থনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠে একসময় তার গল্পও তো আমি এই বইয়েই পড়েছি ।
নর-নারীর মনোদৈহিক অস্থিরতার কাল্পনিক অভিজ্ঞতা আর প্রকৃতির অসীম নাটকীয়তার গোপন পাঠ নিতে গিয়ে কতোরকম অনভিজ্ঞতার ভয়ংকর অথচ সুদর্শন ফাঁদে আটকে পড়েছি একসময়, তার কোন ইয়ত্তা নেই ।
আর এইসব ক্ষেত্রে সময়ে-অসময়ে আমি কতোবার কতোরকম ভাবে যে তাড়িত হয়েছি তার খবর-ই বা ক'জনে রাখে!
সাত.
হায়! শৈশবের উল্লেখযোগ্য কোন স্মৃতি আমার মস্তিষ্ক ধরে রাখতে পারে নি।পরম যত্নে তুলে রাখা একান্ত স্মৃতিগুলোও বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে দিন দিন । যাইহোক, তত্ত্ব আর তথ্যের ভারে নুব্জ্য হয়ে পড়া এই মস্তিষ্কে এখনো আমি আমার প্রথম বই পড়ার স্মৃতি ধরে রেখেছি!
মনে পড়ে, প্রথম প্রথম কমিক্সের বইয়ের প্রতি খুব ঝোঁক ছিল । চাচা চৌধুরি, নন্টে-ফন্টে আরো কতো কি।আহা! সচিত্র ছবির সাথে কাহিনিগুলো পড়তে তখন কি যে ভালো লাগতো ।
মনে আছে, স্কুলের পরিত্যক্ত বুকশেলফ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে 'বামবি' আর 'কাঠেরপুতুল পিনিকিউ' নামের দু'টি বিদেশি কমিক্সের বইও পড়েছিলাম একবার ।
বামবি-সেই ছোট্ট হরিণ ছানা-র মায়াবি মুখটি এখনো চোখের সামনে ভাসছে যেন!
রাশেদ রউফের 'কাকবন্ধু ও ভূতের গল্প' আমার পড়া প্রথম গল্পের বই ।
ভূতের গল্পগুলো এখন আর মনে নেই । হাজারো বৈষয়িক স্মৃতির ভিড়ে সেগুলোকে হারিয়ে ফেলেছি । কাকবন্ধুর গল্পটি এখনো মনে আছে ।
'গল্প'রা হয়তো এভাবেই স্মৃতি তৈরি করে । আর পাঠকের মাঝে বেঁচে থাকে বহুদিন ।
সেসময় প্রচুর ভূতের গল্পও পড়েছি ।
এই ভূত-পেত্নির খপ্পরে পড়ে রাস্তার পাশের ভাসমান দোকানগুলো থেকে কতো কতো ভূত-পেত্নি সংগ্রহ করেছি । আর রাতের বেলা সেগুলো পড়ে পড়ে চেতনে-অবচেতনে কতোবার কতোরকমভাবে শিহরিত হয়েছি, ভাবলেই হাসি পায় এখন । আহা! বোকা শৈশব ।
আরো একটি বইয়ের কথা মনে পড়ছে এই মুহুর্তে ।
নাম 'অশরীরি' । লেখক প্রণব ভট্ট।উপন্যাসটির কাহিনি কি ছিল; তা আজ আর মনে নেই । তবে কালো রঙের প্রচ্ছদটা আবছা আবছা মনে আছে ।
'কাকবন্ধু ও ভূতেরগল্প'র পরে এটিই আমার পড়া প্রথম কোন উপন্যাসের বই।
আট.
ক্রিটিক্যাল চিন্তা-ভাবনা থেকে বই পড়লে পাঠরুচির পরিবর্তন হয় । একই সাথে ব্যাক্তির চিন্তাধারারও । তাছাড়া এক্ষেত্রে লেখকের মতাদর্শিক অবস্থানের সাথে পাঠকের আদর্শিক অবস্থানেরও একটা পরিচয় হয়ে যায় । যার প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক । যখন পাঠকদেরকে রাজনীতি সচেতন, প্রগতিশীল কোন লেখকের বই পড়ে মার্কসীয় দর্শনে প্রভাবিত হয়ে বাম রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখি,তখন তার যৌক্তিক প্রামাণ্যতা ক্রমশ স্পষ্ট হয় ।
আর এর সাথে ধীরে ধীরে যুক্ত হয় মুক্তচিন্তা, মুক্তিবুদ্ধির মতো অনুষঙ্গগুলো । শিল্প-সাহিত্যে যার প্রায়োগিক ব্যাবহার দেখে মুগ্ধ হই । প্রভাবিত হই ।
নির্মোহ আত্মসমীক্ষার কষ্টিপাথরে নিজেকে যাচাই করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগতভাবে এই পাঠাভ্যাস কনজারভেটিভ পাঠকদের পাঠের চেয়ে অধিকতর ফলপ্রসূ বলে মনে করি ।
নয়.
যখন কোন বই পড়ি, তার সাথে লেখকের দার্শনিক উপলব্ধির ভেতর দিয়ে যাই; তখন নিজের চিন্তার মধ্যে একটা আশ্চর্যজনক তারতম্যের উপস্থিতি টের পাই!
তাই কখনো কখনো যেই বইটি পড়ছি সেটি বন্ধ করে দিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকি । চিন্তা করি । লেখকের ভাবনাকে নিজের মতো করে ভাববার চেষ্টা করি । অবশ্য এর ফলাফল যে সবসময় ইতিবাচক হয় এমনও না!
আবার কখনো কখনো নিজের ধারণাকে এগিয়ে রেখে পাঠ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও লেখকের সাথে বেশিরভাগ সময় ঠিক পেরে উঠি না । তখন নগন্য পাঠক হিসেবে একধরনের আত্মগ্লানি কাজ করে ।
দশ.
বইপড়ার কথা বলতে গিয়ে আসলে এখানে অামি নিজের কথাই বলেছি ।
নিজেই নিজের গীতি গেয়েছি; অনেকটা বইয়ের সাথে সাথে নিজেকে পড়ার মতো করে ।
আর আপন আলয়ের গান তো নিজেকেই গাইতে হয়, নিজের মতো করে, আত্মমগ্ন হয়ে, ধীরে ধীরে, খুব নিবিড়ভাবে!
পুনশ্চ, এটি দীর্ঘ সময় নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে লিখিত হয়েছে; তারপরও শুধুমাত্র বইপড়াকে বিবেচনার কেন্দ্রে রাখলে প্রতিটি পর্বের মধ্যে হয়তো একটা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে, একইসাথে প্রাসঙ্গিকভাবে আমার স্মৃতি-পাঠ-চিন্তা-রুচি-বোধ আর বাতিরও!
অাদৌ কি?
কে জানে...
রচনাকাল~
২/৫/'১৮ইং--১৯/৬/'১৮ইং
Saturday, 23 June 2018
বইমেলা
প্রতিবছর ফ্রেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় বাংলা একাডেমী ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতি আয়োজিত 'একুশে বইমেলা'কে নিয়ে বাঙালী সাহিত্যপ্রেমীদের উচ্ছ্বাস আর আগ্রহের শেষ নেয়। বইকে নিয়ে এতবড় ও দীর্ঘস্থায়ী আয়োজন পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। এই একটা মাসকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশ আর বই বিক্রির ধুম পড়ে যায়।একই সাথে বেড়ে যায় লেখক-প্রকাশকদের ব্যস্ততাও। তাছাড়া আর্থিক-বাণিজ্যিক দিক দিয়েও এর একটা উপযোগিতা আছে বৈকি।
এই একমাসে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে বিবিধ বিষয়ে হাজার হাজার বই বের হয়। মানসম্পন্ন বই প্রকাশে প্রত্যেক প্রকাশনীর আলাদা স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। তবে হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে শিল্পের বিচারে কয়টি বই উত্তীর্ণ হতে পেরেছে?
এমন একটা প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়।কেননা শিল্পের শক্তি ,শিল্পীর দায়-দায়িত্ব সম্মন্ধে লেখকের যথেষ্ট জানা-শুনা আছে কিনা? শিল্পী হিসেবে এই যন্ত্র ও যন্ত্রণার যুগে একজন লেখকের যে সংকট-সমস্যার অনুভূতি থাকা প্রয়োজন তা আছে কিনা? কিংবা এক্ষেত্রে তার উপলব্ধি রাষ্ট্র-সমাজকে ছাপিয়ে শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত চিন্তায় পর্যবসিত হয়েছে কিনা?
বইয়ের মানোন্নয়নের প্রশ্নে উপর্যুপরি এমন সব প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে।একই সাথে কয়টি বই পাঠকের চিন্তার বিবর্তনের পথকে উম্মুক্ত করেছে, কোন কোন বই পাঠকের চিন্তারাজ্যে ঝড় তুলেছে ; তার একটা হিসাব করার অনিবার্য বাস্তবতাও প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে।
এর সাথে সাহিত্যকে পুঁজি করে শিল্পের যে অযাচিত ব্যাবহার উঠতি লেখকেরকে করতে দেখা যাচ্ছে,তা যুগপৎভাবে আমদেরকে হতাশ ও আশান্বিত করে। এখানে একথাও বলে রাখা জরুরি যে, বইকে পণ্য করে বিজ্ঞাপনের বহুমূখী পন্থা অবলম্বনের ক্ষেত্রে তরুণ লেখকেরা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়নের প্রশ্নে তা মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে। একই সাথে হরেক রকম বিজ্ঞাপনের ভিড়ে মননশীল লেখকদের লেখাও চাপা পরে যেতে পারে তাদের বৈষয়িক সাহিত্যের সুদর্শন ঘেরাটোপে!
তবে আশার কথা এই যে,এসবের মাঝেও কিছু ধ্যানী তরুণ জগতের তাবৎ মগ্নতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে সাহিত্যের নিত্যনতুন দিগন্তের খবর তাদের নিরীক্ষাধর্মী গল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে আমাদের জানাচ্ছেন। যেটা আমাদেরকে আশান্বিত করে। কবিতার ক্ষেত্রে নতুন কন্ঠস্বর তৈরিতে তাদের যে শাব্দিক-ভাষিক করুকার্যতা,ভাব-সঙ্গতির যে অপূর্ব চিত্রায়ণ ; বাংলা সাহিত্যের জন্য তা আশাজাগানিয়া।
বাঙালি পাঠক সমাজকে নিয়ে সামষ্টিকভাবে কিছু বলার নেই। তাদের মধ্যে ব্যক্তি পছন্দকে এগিয়ে রেখে বই কেনার একটা আদিম প্রথা অনেক আগে থেকেই চালু আছে। তবে ইদানিং শুধুমাত্র অন্যের পছন্দ-অপছন্দের উপর ভর করে বই কেনার একটা প্রবণতা পাঠকদের মাঝে দেখা যাচ্ছে। অবশ্য ভক্ত-পাঠকদের মাঝেই এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এই শ্রেণির পাঠকদের সিংহভাগই আবার বয়সে তরুণ। তারপরও জ্ঞানের বহুমাত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে এটি বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করি। কেননা সিরিয়াস পাঠকেরা বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে গুরুত্ব দেয় বেশি।কখনোই অন্যের পাঠরুচিকে পুঁজি করে এরা বই নির্বাচন করে না।তবে সব কিছুর যেমব ব্যতিক্রম আছে, এক্ষেত্রেও তেমন কিছু ব্যতিক্রম আছে!
বইমেলা নিয়ে লেখাটি শুরু করলেও স্থানিক প্রেক্ষাপটে জায়গায় জায়গায় আলোচনার মোড় ঘুরে গেছে। এটি যে সচেতন ভাবে করা হয়েছে তা নয়। অনেকটা নিজের অজান্তেই হয়ে গেছে।আসলে মাঝে মাঝে বইমেলা নিয়ে নিজের মধ্যে একটা হতাশা কাজ করে। বইকে নিয়ে যখন ব্যবসা করা হয়। সুকৌশলে যখন চেতনার নামে মৌলবাদী ধ্যান ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বইয়ের মধ্যে। তখন সত্যিই আশাহত হই!
এত সবকিছুর পরেও নানা প্রতিবন্ধকতা-সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বইমেলা স্বমহীমায় আমাদের নাগরিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে।প্রতিবছর আমাদের মাঝে আসবে নির্মোহ আত্মসমীক্ষার কষ্টিপাথর হয়ে,যার মধ্যে আমরা আমাদের বৈষয়িক যাপিত জীবনের বাইরে নিজেকে একটু পরিশুদ্ধ করতে পারি!
রচনাকাল~ ১৬/০২/২০১৮
Friday, 25 May 2018
উপন্যাসের পথে
এই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়টিই তুলনামূলকভাবে ভালো লেগেছে প্রথম অধ্যায়ের চেয়ে।পুরো বইটি এই দুই আধ্যায়েই লেখা যদিও।
রাতারাতি বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বনতে চাওয়া একজন তরুণের ক্রমশ পরিণত ঔপন্যাসিক হওয়ার অভিজ্ঞতা আর তার শৈল্পিক প্রক্রিয়ার প্রাণবন্ত আলোচনাই এই অধ্যায়ের প্রতিপাদ্য বিষয়। সংলাপের আইডিয়াটা যদিও চমৎকার।কিন্তু মাঝে মাঝে সেটাকে আদিখ্যেতাই মনে হয়েছে আমার। তবে লেখকের জন্য বিষয়টি হয়তো গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
লেখকদের লেখালেখির প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের, পাঠকদের মধ্যে একটা কৌতূহল কাজ করে সবসময়। এই কৌতূহল যদিও বেশিরভাগ সময় কৌতূহলই থেকে যায়। তারপরও লেখকদের এই ধরণের মুক্ত্যগদ্যের বই কখনো-সখনো সেইসব কৌতূহল উপশমকারী হিসেবে কাজ করে বৈকি।
'উপন্যাসের পথে' আমার পড়া স্বকৃত নোমানের দ্বিতীয় বই।এর আগে তার একটা উপন্যাস পড়েছিলাম।
'ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরষ্কার' এবং 'এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন তরুণ সাহিত্য পুরষ্কার' প্রাপ্ত উপন্যাস 'কালকেউটের সুখ'।
যাইহোক, এর আগে এই ধারার আরো একটি বই পড়েছিলাম। প্রিয় লেখক আহমাদ মোস্তফা কামালের মুক্তগদ্যের বই 'একদিন সবকিছু গল্প হয়ে যায়'। উভয়টিই লেখালেখি বিষয়ক মুক্তগদ্যের বই হলেও বই দুইটির আঙ্গিক আর গদ্যভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা।
লেখকের সাহিত্যচর্চার সামগ্রিক একটা তথ্যচিত্র পেয়েছি এই বইয়ে। লেখক তার প্রথম উপন্যাস 'নাভি' কে নিয়ে দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করেছেন। সেই উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিত সাপেক্ষে লেখকের এইসব বয়ান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি সংবাদের শিরোনাম থেকে কিভাবে 'এইচএসবিসি-কালি ও কলম' পুরষ্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস 'রাজনটী'র জন্ম হয় ; তার ইতিবৃত্ত পড়ে যারপরনাই অবাক হয়েছি।
নির্যাতিত-নিপীড়িত রোহিঙ্গা জাতিকে নিয়ে লেখা উপন্যাস 'বেগানা'র রচনার নেপথ্য কাহিনীও বেশ চমকপ্রদ।
এরপর ধারাবাহিকভাবে এসেছে শমসের গাজীকে নিয়ে তাঁর উপন্যাস 'হীরকডানা'র কথা। ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত ইতিহাসে অসততার যে ধারা, তার থেকে বেরিয়ে এসে, বিস্মৃত হতে থাকা একজন বীরের জীবনের ইতিবৃত্তকে ক্রমান্বয়ে সত্য ইতিহাসের নির্যাস আর কল্পনার মিশেলে উপন্যাসে রূপান্তর করার অভিজ্ঞতার কথা বিবৃত হয়েছে।
তাঁর গল্পগ্রন্থ 'নিশিরঙ্গিনী' এবং 'বালিহাঁসের ডাক' এর গল্পগুলোর আলোচনায় প্রসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে একজন গল্পকারের গল্পভাবনা, একইসাথে মূর্ত হয়ে উঠেছে সেগুলোর গল্প হয়ে উঠা-না হয়ে উঠার ব্যাপারে তাঁর লেখকসুলভ দ্বিধামিশ্রিত সময়ের চিত্র।
সর্বশেষ উপন্যাস 'শেষ জাহাজের আদমেরা'র রচনার প্রেক্ষাপট এবং তার সাথে ঔপন্যাসিকের ইতিহাস ও শিল্পের যে বিন্দুকে স্পর্শ করার আকাঙ্খার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে বইয়ের শেষের দিকে, সেটি স্পর্শ করতে পেরেছেন কিনা? তা নির্ণয়ের দায়িত্ব,একইসঙ্গে উপন্যাসটি লেখার সার্থকতা নিরূপনের ভার যথারীতি পাঠকের উপরই ন্যাস্ত করা হয়েছে।
মোটের উপর একটি উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে একজন ঔপন্যাসিকের যে শৈল্পিক প্রচেষ্টা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের যে খাটুনি একই সাথে বিষয়ভিত্তিক পাঠ নেওয়া এবং তার শিল্পসঙ্গত ব্যাবহারের নান্দনিক অভিযাত্রা, এই বই পাঠান্তে তার একটা সামগ্রিক ধারণা পেয়েছি।
এই বইয়ের কি কোন সমালোচনা করা যায়?
লেখকের এই বই লেখার উদ্দেশ্য সাপেক্ষে এবং সর্বোপরি বইটির একজন মুগ্ধ পাঠক হিসেবে বলছি-না। কারণ ঔপন্যাসিকের জীবনধারা ও উপন্যাস বিষয়ে এই বইটিতে অন্তর্ভুক্ত লেখাগুলির উপর আগামী দিনে স্থির না থাকতে পারার (আপাত) একটি শঙ্কার কথা লেখক আমাদের জানিয়েছেন।একজন পাঠক হিসেবে যার প্রভাব আমার উপরও অল্প-বিস্তর কার্যকর।
কে জানে? একদিন হয়তো আমি নিজেই আমার এই মুগ্ধতার উপর স্থির থাকবো না!
তাই সমালোচনা নয়,শুধুমাত্র মুগ্ধতার কথাগুলি তোলা থাকুক।
পুনশ্চ-১
বইটির প্রথম অধ্যায়ের 'আরোপিত' ভঙ্গির কথাগুলো আমার তেমন ভাল লাগে নি। বিশ্বাসী বলেই হয়তো এমনটা হয়েছে!
পুনশ্চ-২
(লেখকের বাড়তি পাওয়া হিসেবে) এই কথাগুলো একদিন আমার কাজে আসবে। অদূরভবিষ্যতে হয়তো আরো অনেকেরই আসবে।
পাঠশেষে এই-ই প্রাপ্তি!
বই সম্পর্কে~
নাম- উপন্যাসের পথে
লেখক-স্বকৃত নোমান
প্রচ্ছদ-শতাব্দী জাহিদ
প্রকাশক-আলোঘর প্রকাশনা
মূল্য-২০০ টাকা
Saturday, 5 May 2018
মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম
বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যে বীজ রোপিত হয়েছিল বাঙালির চিন্তায় চেতনায়;মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একসময় সেটি মহীরুহে পরিণত হয়।যার শিকড় আজও প্রতিটি বাঙালির চেতনার গভীরে প্রোথিত।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে একধরণের হিস্ট্রিক্যাল ডিসেপশনের শিকার হতে হয়।কারণ আমাদের দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার যে ধারা পরিলক্ষিত হয়,তা অনেকটা রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে সেক্যুলারপন্থীদের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত।
ইতিপূর্বে যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তাদের অধিকাংশই দলগত আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে মুক্তিযুদ্ধের বয়ানকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র মুখোশ পরিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন।
বাস্তবতা বিবর্তিত-বিবর্জিত এই ইতিহাস রচনার ধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ইতিহাস রচনার উপাদান সমূহকে নতুন এঙ্গেল থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সেগুলোকে নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করাটা বাস্তবিক পক্ষে শুধু সময়ের দাবি ছিল না বরং কালিক প্রেক্ষাপটে এর প্রয়োজনীয়তা অনিবার্যভাবে অনেক আগে থেকেই ছিল।কিন্তু মতাদর্শিক সংকীর্ণতা থেকে দূরে সরে,স্বত্বাগত হিংসা-দ্বেষ থেকে বেরিয়ে এসে বাম-সেক্যুলারপন্থীদের নৈতিক অবস্থান থেকে ইতিহাস রচনা করাটা আদতে কখনোই সম্ভব হয়নি।
এমন সময়ে তথ্য,তত্ত্ব ও সত্যের অপূর্ব সমন্বয়ে দালিলিক ইতিহাস রচনা করেছেন বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য।বিষয়বস্তুর দিক থেকে তার বই "মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম" সামগ্রিকভাবে সেই ইঙ্গিতই বহন করে।
বইটিতে লেখক "বয়ান" শব্দটিকে চিন্তার কন্সট্রাকশন বা চিন্তা-কাঠামো অর্থে ব্যবহার করেছেন।আমাদের দেশে ইতিহাস রচনার যে ঐতিহ্য,ইতিহাসবিদদের চিন্তার যে বৈচিত্র ও বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়,ইসলামের প্রশ্নে পর্যালোচনার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের সর্বজনগ্রাহ্য দলিল সমূহ থেকে সেগুলোকে তুলে এনে তাদের মাঝে সাদৃশ্যতা অনুসন্ধানে লেখকের যে প্রয়াস;কাঠামোবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সেটিকে যথার্থই মনে হয়।
"মুক্তিযুদ্ধ নির্মাণের বয়ান-বক্তৃতায় ইসলাম" প্রসঙ্গে বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে উপস্থাপিত দালিলিক পর্যালোচনা থেকে বুঝা যায়,মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রেরণা হিসেবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামের অবস্থান কিরকম ছিল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে তৎকালীন সচেতন আলেম সমাজের ভূমিকা কেমন ছিল।অধ্যায়ের শেষে কওমি ধারার আলেমদের যে অংশটি মুক্তিযুদ্ধকালীন নীরব ভূমিকা পালন করেছিল তাদের ব্যাপারেও একটা স্পেসিফিক ধারণা পাওয়া যায়।
বইটির পঞ্চম অধ্যায়ে "মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীতাকারীদের বুঝাতে ইসলামের প্রতীক ও চিহ্নের বিকৃত উপস্থাপন" নিয়ে যে পর্যালোচনা করা হয়েছে তাতে দু'টি বিষয় স্পষ্ট হয়।
এক. যে ইসলামপন্থি দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতায় মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল,তার দায়ভার পরবর্তীতে অন্যান্য ইসলামপন্থিদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা সেক্যুলারপন্থীদের মাঝে দেখা যায় সেটা কতটা যৌক্তিক।
দুই. মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীপক্ষের লোক মাত্রই দাড়ি-টুপি ওয়ালা মানুষ;এটা বুঝাতে ইসলামি চিহ্ন সমূহকে প্রতীকায়িতভাবে যত্রতত্র এর বিকৃত উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তাদের যে মানসিক অবস্থান সেটা কতটা নৈতিক।
এই অধ্যায় পাঠে এসব প্রশ্নের কিছু দালিলিক উত্তর মিলতে পারে।
বর্তমানে আমাদের দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের যে উল্লেখ রয়েছে,মূলনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সাপেক্ষে এর প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু ছিল।ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করার আবশ্যিকতা কিংবা যৌক্তিক অনিবার্যতা মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কেমন ছিল।পরবর্তীতে সেটিকে মূলনীতি হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত কিভাবে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছিল;বইটির সপ্তম অধ্যায়ে তার একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করা হয়েছে।যা নিঃসন্দেহে যুগপৎভাবে এ বিষয়ে ইতিহাসের ভিন্ন পাঠ নিতে এবং অগ্রসর পাঠকদের চিন্তার খোরাক যোগাতে সাহায্য করবে।
পরিশেষে বইটি সামগ্রিকভাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক বাস্তবতা উপলব্ধির নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করি...
(মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম-পিনাকী ভট্টাচার্য,গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স)
Sunday, 25 March 2018
জলপাই রঙের কোট
মুক্তিযুদ্ধের একটি ঘটনার প্রত্যক্ষ বর্ণনা দিয়ে উপন্যাসের শুরু।
যে ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়,মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঘটে যাওয়া বাঙালিদের অনেক গোপন অথচ বীরত্বপূর্ণ কাহিনীর কথা।
যাতে আছে রজব আলীর মতো কাপুরুষ বিশ্বাসঘাতকদের নিজের দেশের সাথে বেইমানী করার অকপট বর্ণনা।অার রফিক,ইয়াসিন,ফজলদের মতো দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধাদের বীরত্বের অপূর্ব সব কাহিনী।
তারপর থেকে ফ্ল্যাশব্যাক দিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলে উপন্যাসের কাহিনী।
বাঙালির ইতিহাসের সোনালি সব অধ্যায়ের বর্ণনা মূর্ত হয়ে উঠে একজন হতভাগা মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিচারণে।
আর গ্রামের মেটোপথে মুক্তিযুদ্ধের গল্প খুঁজতে যাওয়া একদল তরুণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে সেসব যুদ্ধদিনের কথা।
আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি,লেখকের মেদহীন গদ্যে জীবন্ত হয়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধকালে সুবীরময় সেনের মতো সংখ্যালঘুদের উপর ইউসুফ সাহেবদের মানসিক নির্যাতনের অকথ্য সব দৃশ্যপটের করুণ বর্ণনা।
রেনুকার মতো নিঃসন্তান গৃহবধূদের সামাজিকভাবে নিগ্রহীত হওয়ার;আত্মগ্লানি নিয়ে স্বামীর বুকে মুখ লুকানোর গোপন সব না বলা গল্পের কথা।
সুবীরময় সেনের স্ত্রী বিমলার মতো অনেক নারীর স্বামীর পথ চেয়ে আপেক্ষা করার অজানা সব গল্প।লেখকের দৃশ্যকল্পে চিত্রটি ধরা পরে এভাবে-
তবু মনের ভেতর নিভু নিভু করে জ্বলে উঠে দ্বীপটি।একদিন আঁধার ক্ষয়ে ক্ষয়ে নামবে ভোর।টকটকে একটা সূর্য দেখা দেবে পুবের আকাশে।সেই সূর্যকিরণ ছড়িয়ে পড়বে চারিপাশে।বিমলা তাই আশায় বুক বাঁধেন।
আছে তার কন্যা দীপার মতো মেয়েদের অনেক গল্পকথা।যেখানে আছে একটি মেয়ের মনে স্বপ্নের পুরুষকে নিয়ে তিলে তিলে গড়ে উঠা সম্ভাবনাময় প্রেমের অসংখ্য উপাখ্যানপর্ব।
সেই সম্ভাব্য প্রেমের সম্ভাব্য পরিণতিকে লেখক চিত্রায়িত করেছেন তার সজীব-নির্বিকল্প গদ্যশৈলীর মাধ্যমে-
ডুবতে ডুবতেও দীপার চোখজুড়ে নেচে বেড়ায় অজানা স্বপ্ন এক।থেকে থেকে দুলে দুলে উঠে।হাওয়া লাগে নিভে যায়।নিভে যায় হাওয়া লাগে।ফুল ফুটে ফুল ঝরে।তবুও প্রতীক্ষা জীবনের।আশ্চর্য মানুষের এই টিকে থাকার লড়াই।
বলাই বাহুল্য পুরো উপন্যাসে আংকেলের ভূমিকায় যিনি আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনিয়েছেন;তিনি আর কেউ নন।উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র,হতভাগা মুক্তিযোদ্ধা সুজিত।সুজিত বড়ুয়া।
যে কিনা একদিন দেশকে ভালবেসে,দেশের জন্যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।কোন ধরণের প্রাপ্তির আশা ছেড়েই।
কিন্তু কখনো কখনো তার নিজের কাছে মনে হয়,মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে একটি কোট ছাড়া প্রাপ্তি হিসেবে তিনি কিছুই পান নি! তখন আপন মনে বলে উঠেন যেটা পেয়েছি সেটাই বা কম কিসের!
পাকা জলপাই রং সেই কোটের।মাঝে মাঝে যখন হতাশা বেড়ে যায়,তখন তিনি এই জলপাই রঙের কোট গায়ে হেঁটে বেড়ান পাড়ার মধ্যে।
যেটি যুদ্ধের সময় একজন পাকিস্তানি অফিসারের শরীর থেকে খুলে নিয়েছিলেন তিনি।
কোটটি গায়ে ছড়ালেই অন্যরকম একটি ভালো লাগা কাজ করে তার মধ্যে।বুকের ছাতি ফুলে উঠে তার!
"জলপাই রঙের কোট" উপন্যাসে চট্টগ্রামের গৈরালা গ্রামের প্রেক্ষাপটে লেখক তুলে ধরেছেন সারা দেশে রক্তপিপাসু হানাদার বাহিনীদের অবর্ণনীয় নির্যাতনের চিত্র।
একই সাথে মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যক্ষ বয়ানে উঠে আসে একাত্তরের সেইসব বীরত্বপূর্ণ আখ্যানের কথা;যেখানে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ একটি মাত্র পতাকার নিচে সমবেত হয়েছিল,
একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে।
উপন্যাসের লেখকের ভাষারীতি,গদ্যশৈলী প্রাণবন্ত।যার কারণে ঐতিহাসিক উপন্যাস হওয়া সত্ত্বেও পাঠকের কাছে বিরক্তিকর লাগবে না।
তবে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ব্যাবহার করার ক্ষেত্রে লেখক তেমন সাবলীল নন।তাছাড়া আঙ্গিক বিচারে আখ্যান বর্ণনায় লেখকের যে প্রয়াস;তা পাঠকের মনযোগ রক্ষা করতে কতটুকু সামর্থ্য হবে?
এমন একটা প্রশ্নও শেষপর্যন্ত থেকে যায়।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা "জলপাই রঙের কোট" উপন্যাসটি একটি দালিলিক উপন্যাস হিসেবে আমাদের বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিবে।পরিশেষে একথা বলতেই পারি।
(জলপাই রঙের কোট-রবিউল করিম মৃদুল,দেশ পাবলিকেশন্স)
Saturday, 17 March 2018
পাপ
সাব্বির জাদিদের ‘পাপ’ পড়ে উঠে মনে হলো, এটা কি পড়লাম আমি! এ আবার কেমন উপন্যাস? যে উপন্যাসের সমাজের সঙ্গে আমার সমাজকে মেলাতে পারি না। উপন্যাসের চরিত্রের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নেই। চরিত্রগুলোর নাম যদিও পরিচিত, তবু বেশ অদ্ভুত। আকাশ, বাতাসি, পাহাড়, সাগরি, নদী, বৈশাখী, পল্লবীসহ অনেক নাম। এদের আচরণও এদের নামের মতো অদ্ভুত।
ছাউনির নিচে বসবাস হলেও এরা বন-জঙ্গলে অবাধে ঘুরে বেড়ায়। বনের পশুদের সঙ্গেও এদের সখ্য রয়েছে। উপন্যাসের জায়গায় জায়গায় পশুপাখির সঙ্গে এদের অদ্ভুত অদ্ভুত আচরণ দেখে অবাক হয়েছি।
আমাদের মতো এরা দলবদ্ধভাবে বসবাস করলেও তাদের সমাজকাঠমো আমাদের চেয়ে ভিন্ন। মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক, নারী-পুরুষের যে সম্পর্ক, এদের কাছে তার একটা অন্যরকম অর্থ রয়েছে!
এটি সময় থেকে ছিটকে পড়া একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার স্বপ্নের ঘোরে বিচরণ করার আখ্যান হলেও এর মধ্যে আমাদের সভ্য সমাজের ‘পাপ’ করার প্রবণতার দিকটি প্রকাশিত হয়েছে ভিন্নভাবে, আদিম যুগের মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে, যা যুগপৎভাবে আমাদের জানান দেয়, মানুষের পদস্খলনের পুনঃপৌনিকতার, বেঁচে থাকার আশ্চর্য সব লড়াইয়ের।
‘কাম’ মানুষের স্বভাবজাত একটি মনোদৈহিক প্রবৃত্তির নাম।এই কামের সঙ্গে পাপের একটা সম্পর্ক আছে। উপন্যাসে এই কামকে উপজীব্য করে অনেক ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে। যার মধ্যে নর-নারীর পরস্পরকে কাছে পাওয়ার যে বাসনা, তা মূর্ত হয়ে ওঠে।
অজ্ঞতা, কল্পনা ও ভয়ভীতি থেকে আদিকালে মানুষ কিভাবে ধর্মের প্রতি ঝুঁকেছে, আর কিছু মানুষ কিভাবে তার প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে, তারই একটা ধারণা পাওয়া যায় এই উপন্যাসের শেষের দিকে। যেখানে দেখা যায়, প্রাত্যহিক জীবনে ঘটে যাওয়া একটি সাধারণ চুরির ঘটনা থেকে কিভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের নামে একটি জনপদের মানুষেরা দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে, কিভাবে রক্তপিপাসু হয়ে ওঠে তারই একটি চিত্র।
সিনেমার মতো এই উপন্যাস শুরু হয়ে শেষ হয়েছে শ্বাসরুদ্ধকর এক অবিশ্বাস্য ঘটনার মধ্য দিয়ে। কল্পনার মাধুরী মিশিয়ে পাপের মৌলিক ধারণা থেকে মানুষ ও ফেরেশতার একইসঙ্গে বসবাসের যে জগৎ রচনা করেছেন লেখক, তার মধ্যে একবার ঢুকলে শেষ না করে বের হওয়া যায় না। এক ধরনের ঘোর লাগা কাজ করে।
এখানে ফেরেশতা-বিষয়ক যে ধারণা ব্যবহার করা হয়েছে, সেটাকে ইসলাম ধর্ম থেকে নেওয়া হলেও এ ধর্মের ফেরেশতাদের সঙ্গে এই উপন্যাসের চরিত্রদের শারীরিক কিংবা আচরণগত কোনো মিল নেই।
উপন্যাসের লেখকের গদ্যশৈলী সহজ-সরল, প্রাণবন্ত। শাব্দিক-ভাষিক কিংবা বর্ণনাগত কোনো জটিলতাও নেই।একনাগাড়ে পড়ে শেষ করে ফেলা যায় এমন একটি উপন্যাস।
(পাপ-সাব্বির জাদিদ,ঐতিহ্য)
বি:দ্র: রিভিউটি 'চিন্তাসূত্রে' প্রকাশিত।লিংক:-http://www.chintasutra.com/2018/03/%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%aa-%e0%a6%b8%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9c-%e0%a6%a7%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%97%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%9a%e0%a6%bf%e0%a6%a4/
Subscribe to:
Posts (Atom)
স্মৃতির কঙ্কাল ও জুলাইয়ের ভূত : এক অন্তর্বীক্ষণ
১. এক বছর পেরিয়ে গেল, অথচ আমার ফেসবুকের সময়রেখা যেন থমকে আছে এক অদৃশ্য বিন্দুতে। হাসিনার পলায়ন কি কেবল একটি শাসনের শেষ ছিল, নাকি মুক্তিকামী ...

-
Illustration : fast-ink-y43tNhAVDNs-unsplash শিল্পীর সৃষ্টি, সে হোক কলমের আঁচড়ে সাহিত্য, তুলির ছোঁয়ায় চিত্রকর্ম, বা সুরের মূর্ছনায় সঙ্গীত...
-
কিছুদিন আগে মেহেদী উল্লাহর একটা লেখা পড়েছিলাম সমকালের কালের খেয়ায়। ‘ফলিত স্বপ্নের বাসনা’ নামে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘গোসলের পুকুরসমূহ’ লেখা...