প্রতিবছর ফ্রেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় বাংলা একাডেমী ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতি আয়োজিত 'একুশে বইমেলা'কে নিয়ে বাঙালী সাহিত্যপ্রেমীদের উচ্ছ্বাস আর আগ্রহের শেষ নেয়। বইকে নিয়ে এতবড় ও দীর্ঘস্থায়ী আয়োজন পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। এই একটা মাসকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশ আর বই বিক্রির ধুম পড়ে যায়।একই সাথে বেড়ে যায় লেখক-প্রকাশকদের ব্যস্ততাও। তাছাড়া আর্থিক-বাণিজ্যিক দিক দিয়েও এর একটা উপযোগিতা আছে বৈকি।
এই একমাসে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে বিবিধ বিষয়ে হাজার হাজার বই বের হয়। মানসম্পন্ন বই প্রকাশে প্রত্যেক প্রকাশনীর আলাদা স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। তবে হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে শিল্পের বিচারে কয়টি বই উত্তীর্ণ হতে পেরেছে?
এমন একটা প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়।কেননা শিল্পের শক্তি ,শিল্পীর দায়-দায়িত্ব সম্মন্ধে লেখকের যথেষ্ট জানা-শুনা আছে কিনা? শিল্পী হিসেবে এই যন্ত্র ও যন্ত্রণার যুগে একজন লেখকের যে সংকট-সমস্যার অনুভূতি থাকা প্রয়োজন তা আছে কিনা? কিংবা এক্ষেত্রে তার উপলব্ধি রাষ্ট্র-সমাজকে ছাপিয়ে শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত চিন্তায় পর্যবসিত হয়েছে কিনা?
বইয়ের মানোন্নয়নের প্রশ্নে উপর্যুপরি এমন সব প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে।একই সাথে কয়টি বই পাঠকের চিন্তার বিবর্তনের পথকে উম্মুক্ত করেছে, কোন কোন বই পাঠকের চিন্তারাজ্যে ঝড় তুলেছে ; তার একটা হিসাব করার অনিবার্য বাস্তবতাও প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে।
এর সাথে সাহিত্যকে পুঁজি করে শিল্পের যে অযাচিত ব্যাবহার উঠতি লেখকেরকে করতে দেখা যাচ্ছে,তা যুগপৎভাবে আমদেরকে হতাশ ও আশান্বিত করে। এখানে একথাও বলে রাখা জরুরি যে, বইকে পণ্য করে বিজ্ঞাপনের বহুমূখী পন্থা অবলম্বনের ক্ষেত্রে তরুণ লেখকেরা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়নের প্রশ্নে তা মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে। একই সাথে হরেক রকম বিজ্ঞাপনের ভিড়ে মননশীল লেখকদের লেখাও চাপা পরে যেতে পারে তাদের বৈষয়িক সাহিত্যের সুদর্শন ঘেরাটোপে!
তবে আশার কথা এই যে,এসবের মাঝেও কিছু ধ্যানী তরুণ জগতের তাবৎ মগ্নতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে সাহিত্যের নিত্যনতুন দিগন্তের খবর তাদের নিরীক্ষাধর্মী গল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে আমাদের জানাচ্ছেন। যেটা আমাদেরকে আশান্বিত করে। কবিতার ক্ষেত্রে নতুন কন্ঠস্বর তৈরিতে তাদের যে শাব্দিক-ভাষিক করুকার্যতা,ভাব-সঙ্গতির যে অপূর্ব চিত্রায়ণ ; বাংলা সাহিত্যের জন্য তা আশাজাগানিয়া।
বাঙালি পাঠক সমাজকে নিয়ে সামষ্টিকভাবে কিছু বলার নেই। তাদের মধ্যে ব্যক্তি পছন্দকে এগিয়ে রেখে বই কেনার একটা আদিম প্রথা অনেক আগে থেকেই চালু আছে। তবে ইদানিং শুধুমাত্র অন্যের পছন্দ-অপছন্দের উপর ভর করে বই কেনার একটা প্রবণতা পাঠকদের মাঝে দেখা যাচ্ছে। অবশ্য ভক্ত-পাঠকদের মাঝেই এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এই শ্রেণির পাঠকদের সিংহভাগই আবার বয়সে তরুণ। তারপরও জ্ঞানের বহুমাত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে এটি বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করি। কেননা সিরিয়াস পাঠকেরা বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে গুরুত্ব দেয় বেশি।কখনোই অন্যের পাঠরুচিকে পুঁজি করে এরা বই নির্বাচন করে না।তবে সব কিছুর যেমব ব্যতিক্রম আছে, এক্ষেত্রেও তেমন কিছু ব্যতিক্রম আছে!
বইমেলা নিয়ে লেখাটি শুরু করলেও স্থানিক প্রেক্ষাপটে জায়গায় জায়গায় আলোচনার মোড় ঘুরে গেছে। এটি যে সচেতন ভাবে করা হয়েছে তা নয়। অনেকটা নিজের অজান্তেই হয়ে গেছে।আসলে মাঝে মাঝে বইমেলা নিয়ে নিজের মধ্যে একটা হতাশা কাজ করে। বইকে নিয়ে যখন ব্যবসা করা হয়। সুকৌশলে যখন চেতনার নামে মৌলবাদী ধ্যান ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বইয়ের মধ্যে। তখন সত্যিই আশাহত হই!
এত সবকিছুর পরেও নানা প্রতিবন্ধকতা-সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বইমেলা স্বমহীমায় আমাদের নাগরিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে।প্রতিবছর আমাদের মাঝে আসবে নির্মোহ আত্মসমীক্ষার কষ্টিপাথর হয়ে,যার মধ্যে আমরা আমাদের বৈষয়িক যাপিত জীবনের বাইরে নিজেকে একটু পরিশুদ্ধ করতে পারি!
রচনাকাল~ ১৬/০২/২০১৮
No comments:
Post a Comment