বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যে বীজ রোপিত হয়েছিল বাঙালির চিন্তায় চেতনায়;মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একসময় সেটি মহীরুহে পরিণত হয়।যার শিকড় আজও প্রতিটি বাঙালির চেতনার গভীরে প্রোথিত।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে একধরণের হিস্ট্রিক্যাল ডিসেপশনের শিকার হতে হয়।কারণ আমাদের দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার যে ধারা পরিলক্ষিত হয়,তা অনেকটা রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে সেক্যুলারপন্থীদের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত।
ইতিপূর্বে যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তাদের অধিকাংশই দলগত আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে মুক্তিযুদ্ধের বয়ানকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র মুখোশ পরিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন।
বাস্তবতা বিবর্তিত-বিবর্জিত এই ইতিহাস রচনার ধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ইতিহাস রচনার উপাদান সমূহকে নতুন এঙ্গেল থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সেগুলোকে নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করাটা বাস্তবিক পক্ষে শুধু সময়ের দাবি ছিল না বরং কালিক প্রেক্ষাপটে এর প্রয়োজনীয়তা অনিবার্যভাবে অনেক আগে থেকেই ছিল।কিন্তু মতাদর্শিক সংকীর্ণতা থেকে দূরে সরে,স্বত্বাগত হিংসা-দ্বেষ থেকে বেরিয়ে এসে বাম-সেক্যুলারপন্থীদের নৈতিক অবস্থান থেকে ইতিহাস রচনা করাটা আদতে কখনোই সম্ভব হয়নি।
এমন সময়ে তথ্য,তত্ত্ব ও সত্যের অপূর্ব সমন্বয়ে দালিলিক ইতিহাস রচনা করেছেন বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য।বিষয়বস্তুর দিক থেকে তার বই "মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম" সামগ্রিকভাবে সেই ইঙ্গিতই বহন করে।
বইটিতে লেখক "বয়ান" শব্দটিকে চিন্তার কন্সট্রাকশন বা চিন্তা-কাঠামো অর্থে ব্যবহার করেছেন।আমাদের দেশে ইতিহাস রচনার যে ঐতিহ্য,ইতিহাসবিদদের চিন্তার যে বৈচিত্র ও বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়,ইসলামের প্রশ্নে পর্যালোচনার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের সর্বজনগ্রাহ্য দলিল সমূহ থেকে সেগুলোকে তুলে এনে তাদের মাঝে সাদৃশ্যতা অনুসন্ধানে লেখকের যে প্রয়াস;কাঠামোবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সেটিকে যথার্থই মনে হয়।
"মুক্তিযুদ্ধ নির্মাণের বয়ান-বক্তৃতায় ইসলাম" প্রসঙ্গে বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে উপস্থাপিত দালিলিক পর্যালোচনা থেকে বুঝা যায়,মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রেরণা হিসেবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামের অবস্থান কিরকম ছিল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে তৎকালীন সচেতন আলেম সমাজের ভূমিকা কেমন ছিল।অধ্যায়ের শেষে কওমি ধারার আলেমদের যে অংশটি মুক্তিযুদ্ধকালীন নীরব ভূমিকা পালন করেছিল তাদের ব্যাপারেও একটা স্পেসিফিক ধারণা পাওয়া যায়।
বইটির পঞ্চম অধ্যায়ে "মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীতাকারীদের বুঝাতে ইসলামের প্রতীক ও চিহ্নের বিকৃত উপস্থাপন" নিয়ে যে পর্যালোচনা করা হয়েছে তাতে দু'টি বিষয় স্পষ্ট হয়।
এক. যে ইসলামপন্থি দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতায় মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল,তার দায়ভার পরবর্তীতে অন্যান্য ইসলামপন্থিদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা সেক্যুলারপন্থীদের মাঝে দেখা যায় সেটা কতটা যৌক্তিক।
দুই. মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীপক্ষের লোক মাত্রই দাড়ি-টুপি ওয়ালা মানুষ;এটা বুঝাতে ইসলামি চিহ্ন সমূহকে প্রতীকায়িতভাবে যত্রতত্র এর বিকৃত উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তাদের যে মানসিক অবস্থান সেটা কতটা নৈতিক।
এই অধ্যায় পাঠে এসব প্রশ্নের কিছু দালিলিক উত্তর মিলতে পারে।
বর্তমানে আমাদের দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের যে উল্লেখ রয়েছে,মূলনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সাপেক্ষে এর প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু ছিল।ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করার আবশ্যিকতা কিংবা যৌক্তিক অনিবার্যতা মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কেমন ছিল।পরবর্তীতে সেটিকে মূলনীতি হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত কিভাবে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছিল;বইটির সপ্তম অধ্যায়ে তার একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করা হয়েছে।যা নিঃসন্দেহে যুগপৎভাবে এ বিষয়ে ইতিহাসের ভিন্ন পাঠ নিতে এবং অগ্রসর পাঠকদের চিন্তার খোরাক যোগাতে সাহায্য করবে।
পরিশেষে বইটি সামগ্রিকভাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক বাস্তবতা উপলব্ধির নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করি...
(মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম-পিনাকী ভট্টাচার্য,গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স)
No comments:
Post a Comment