Translate

Friday, 25 May 2018

উপন্যাসের পথে

এই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়টিই তুলনামূলকভাবে ভালো লেগেছে প্রথম অধ্যায়ের চেয়ে।পুরো বইটি এই দুই আধ্যায়েই লেখা যদিও।

রাতারাতি বিখ্যাত ঔপন্যাসিক বনতে চাওয়া একজন তরুণের ক্রমশ পরিণত ঔপন্যাসিক হওয়ার অভিজ্ঞতা আর তার শৈল্পিক প্রক্রিয়ার প্রাণবন্ত আলোচনাই এই অধ্যায়ের প্রতিপাদ্য বিষয়। সংলাপের আইডিয়াটা যদিও চমৎকার।কিন্তু মাঝে মাঝে সেটাকে আদিখ্যেতাই মনে হয়েছে আমার। তবে লেখকের জন্য বিষয়টি হয়তো গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

লেখকদের লেখালেখির প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের, পাঠকদের মধ্যে একটা কৌতূহল কাজ করে সবসময়। এই কৌতূহল যদিও বেশিরভাগ সময় কৌতূহলই থেকে যায়। তারপরও লেখকদের এই ধরণের মুক্ত্যগদ্যের বই কখনো-সখনো সেইসব কৌতূহল উপশমকারী হিসেবে কাজ করে বৈকি।

'উপন্যাসের পথে' আমার পড়া স্বকৃত নোমানের দ্বিতীয় বই।এর আগে তার একটা উপন্যাস পড়েছিলাম।
'ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরষ্কার' এবং 'এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন তরুণ সাহিত্য পুরষ্কার' প্রাপ্ত উপন্যাস 'কালকেউটের সুখ'।

যাইহোক, এর আগে এই ধারার আরো  একটি  বই পড়েছিলাম। প্রিয় লেখক আহমাদ মোস্তফা কামালের মুক্তগদ্যের বই 'একদিন সবকিছু গল্প হয়ে যায়'। উভয়টিই লেখালেখি বিষয়ক মুক্তগদ্যের বই হলেও বই দুইটির আঙ্গিক আর গদ্যভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা।

লেখকের সাহিত্যচর্চার সামগ্রিক একটা তথ্যচিত্র পেয়েছি এই বইয়ে। লেখক তার প্রথম উপন্যাস 'নাভি' কে নিয়ে দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করেছেন। সেই উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিত সাপেক্ষে লেখকের এইসব বয়ান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি সংবাদের শিরোনাম থেকে কিভাবে 'এইচএসবিসি-কালি ও কলম' পুরষ্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস 'রাজনটী'র জন্ম হয় ; তার ইতিবৃত্ত পড়ে যারপরনাই অবাক হয়েছি।

নির্যাতিত-নিপীড়িত রোহিঙ্গা জাতিকে নিয়ে লেখা উপন্যাস 'বেগানা'র রচনার নেপথ্য কাহিনীও বেশ চমকপ্রদ।
এরপর ধারাবাহিকভাবে এসেছে শমসের গাজীকে নিয়ে তাঁর উপন্যাস 'হীরকডানা'র কথা। ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত ইতিহাসে অসততার যে ধারা, তার থেকে বেরিয়ে এসে, বিস্মৃত হতে থাকা একজন বীরের জীবনের ইতিবৃত্তকে ক্রমান্বয়ে সত্য ইতিহাসের নির্যাস আর কল্পনার মিশেলে উপন্যাসে রূপান্তর করার অভিজ্ঞতার কথা বিবৃত হয়েছে।
তাঁর গল্পগ্রন্থ 'নিশিরঙ্গিনী' এবং 'বালিহাঁসের ডাক' এর গল্পগুলোর আলোচনায় প্রসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে একজন গল্পকারের গল্পভাবনা, একইসাথে মূর্ত হয়ে উঠেছে সেগুলোর গল্প হয়ে উঠা-না হয়ে উঠার ব্যাপারে  তাঁর লেখকসুলভ দ্বিধামিশ্রিত সময়ের চিত্র।
সর্বশেষ উপন্যাস 'শেষ জাহাজের আদমেরা'র রচনার প্রেক্ষাপট এবং তার সাথে ঔপন্যাসিকের  ইতিহাস ও শিল্পের যে  বিন্দুকে স্পর্শ করার আকাঙ্খার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে বইয়ের শেষের দিকে, সেটি স্পর্শ করতে পেরেছেন কিনা? তা নির্ণয়ের দায়িত্ব,একইসঙ্গে উপন্যাসটি লেখার সার্থকতা নিরূপনের ভার যথারীতি পাঠকের উপরই ন্যাস্ত করা হয়েছে।

মোটের উপর একটি উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে একজন ঔপন্যাসিকের যে শৈল্পিক প্রচেষ্টা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের যে খাটুনি একই সাথে বিষয়ভিত্তিক পাঠ নেওয়া এবং তার শিল্পসঙ্গত ব্যাবহারের নান্দনিক অভিযাত্রা, এই বই পাঠান্তে তার একটা সামগ্রিক ধারণা পেয়েছি।

এই বইয়ের কি কোন সমালোচনা করা যায়?
লেখকের এই বই লেখার উদ্দেশ্য সাপেক্ষে এবং সর্বোপরি বইটির একজন মুগ্ধ পাঠক হিসেবে বলছি-না। কারণ ঔপন্যাসিকের জীবনধারা ও উপন্যাস বিষয়ে এই বইটিতে অন্তর্ভুক্ত লেখাগুলির উপর আগামী দিনে স্থির না থাকতে পারার (আপাত) একটি শঙ্কার কথা লেখক আমাদের জানিয়েছেন।একজন পাঠক হিসেবে যার প্রভাব আমার উপরও অল্প-বিস্তর কার্যকর।
কে জানে? একদিন হয়তো আমি নিজেই আমার এই মুগ্ধতার উপর স্থির থাকবো না!
তাই সমালোচনা নয়,শুধুমাত্র মুগ্ধতার কথাগুলি তোলা থাকুক।

পুনশ্চ-১
বইটির প্রথম অধ্যায়ের 'আরোপিত' ভঙ্গির কথাগুলো আমার তেমন ভাল লাগে নি। বিশ্বাসী বলেই হয়তো এমনটা হয়েছে!

পুনশ্চ-২
(লেখকের বাড়তি পাওয়া হিসেবে) এই কথাগুলো একদিন আমার কাজে আসবে। অদূরভবিষ্যতে হয়তো আরো অনেকেরই আসবে।
পাঠশেষে এই-ই প্রাপ্তি!

বই সম্পর্কে~
নাম- উপন্যাসের পথে
লেখক-স্বকৃত নোমান
প্রচ্ছদ-শতাব্দী জাহিদ
প্রকাশক-আলোঘর প্রকাশনা
মূল্য-২০০ টাকা



Saturday, 5 May 2018

মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম

বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যে বীজ রোপিত হয়েছিল বাঙালির চিন্তায় চেতনায়;মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একসময় সেটি মহীরুহে পরিণত হয়।যার শিকড় আজও প্রতিটি বাঙালির চেতনার গভীরে প্রোথিত।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে একধরণের হিস্ট্রিক্যাল ডিসেপশনের শিকার হতে হয়।কারণ আমাদের দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার যে ধারা পরিলক্ষিত হয়,তা অনেকটা রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে সেক্যুলারপন্থীদের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত।
ইতিপূর্বে যারা ইতিহাস রচনা করেছেন তাদের অধিকাংশই দলগত আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে মুক্তিযুদ্ধের বয়ানকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র মুখোশ পরিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন।

বাস্তবতা বিবর্তিত-বিবর্জিত এই ইতিহাস রচনার ধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ইতিহাস রচনার উপাদান সমূহকে নতুন এঙ্গেল থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে সেগুলোকে নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করাটা বাস্তবিক পক্ষে শুধু সময়ের দাবি ছিল না বরং কালিক প্রেক্ষাপটে এর প্রয়োজনীয়তা অনিবার্যভাবে অনেক আগে থেকেই ছিল।কিন্তু মতাদর্শিক সংকীর্ণতা থেকে দূরে সরে,স্বত্বাগত হিংসা-দ্বেষ থেকে বেরিয়ে এসে বাম-সেক্যুলারপন্থীদের নৈতিক অবস্থান থেকে ইতিহাস রচনা করাটা আদতে কখনোই সম্ভব হয়নি।

এমন সময়ে তথ্য,তত্ত্ব ও সত্যের অপূর্ব সমন্বয়ে দালিলিক ইতিহাস রচনা করেছেন বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় লেখক পিনাকী ভট্টাচার্য।বিষয়বস্তুর দিক থেকে তার বই "মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম" সামগ্রিকভাবে সেই ইঙ্গিতই বহন করে।

বইটিতে লেখক "বয়ান" শব্দটিকে চিন্তার কন্সট্রাকশন বা চিন্তা-কাঠামো অর্থে ব্যবহার করেছেন।আমাদের দেশে ইতিহাস রচনার যে ঐতিহ্য,ইতিহাসবিদদের চিন্তার যে বৈচিত্র ও বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়,ইসলামের প্রশ্নে পর্যালোচনার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের সর্বজনগ্রাহ্য দলিল সমূহ থেকে সেগুলোকে তুলে এনে তাদের মাঝে সাদৃশ্যতা অনুসন্ধানে লেখকের যে প্রয়াস;কাঠামোবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সেটিকে যথার্থই মনে হয়।

"মুক্তিযুদ্ধ নির্মাণের বয়ান-বক্তৃতায় ইসলাম" প্রসঙ্গে বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে উপস্থাপিত দালিলিক পর্যালোচনা থেকে বুঝা যায়,মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রেরণা হিসেবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইসলামের অবস্থান কিরকম ছিল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে তৎকালীন সচেতন আলেম সমাজের ভূমিকা কেমন ছিল।অধ্যায়ের শেষে  কওমি ধারার আলেমদের যে অংশটি মুক্তিযুদ্ধকালীন নীরব ভূমিকা পালন করেছিল তাদের ব্যাপারেও একটা স্পেসিফিক ধারণা পাওয়া যায়।

বইটির পঞ্চম অধ্যায়ে "মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীতাকারীদের বুঝাতে ইসলামের প্রতীক ও চিহ্নের বিকৃত উপস্থাপন" নিয়ে যে পর্যালোচনা করা হয়েছে তাতে দু'টি বিষয় স্পষ্ট হয়।

এক. যে ইসলামপন্থি দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতায় মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল,তার দায়ভার পরবর্তীতে অন্যান্য ইসলামপন্থিদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা সেক্যুলারপন্থীদের মাঝে দেখা যায় সেটা কতটা যৌক্তিক।
দুই. মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীপক্ষের লোক মাত্রই দাড়ি-টুপি ওয়ালা মানুষ;এটা বুঝাতে ইসলামি চিহ্ন সমূহকে প্রতীকায়িতভাবে যত্রতত্র এর বিকৃত উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তাদের যে মানসিক অবস্থান সেটা কতটা নৈতিক।
এই অধ্যায় পাঠে এসব প্রশ্নের কিছু দালিলিক উত্তর মিলতে পারে।

বর্তমানে আমাদের দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের যে উল্লেখ রয়েছে,মূলনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সাপেক্ষে এর প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু ছিল।ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করার  আবশ্যিকতা কিংবা যৌক্তিক অনিবার্যতা মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কেমন ছিল।পরবর্তীতে সেটিকে মূলনীতি  হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত কিভাবে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছিল;বইটির সপ্তম অধ্যায়ে তার একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করা হয়েছে।যা নিঃসন্দেহে যুগপৎভাবে এ বিষয়ে ইতিহাসের ভিন্ন পাঠ নিতে এবং অগ্রসর পাঠকদের চিন্তার খোরাক যোগাতে সাহায্য করবে।

পরিশেষে বইটি সামগ্রিকভাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক বাস্তবতা উপলব্ধির নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করি...

(মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম-পিনাকী ভট্টাচার্য,গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স)


স্মৃতির কঙ্কাল ও জুলাইয়ের ভূত : এক অন্তর্বীক্ষণ

১. এক বছর পেরিয়ে গেল, অথচ আমার ফেসবুকের সময়রেখা যেন থমকে আছে এক অদৃশ্য বিন্দুতে। হাসিনার পলায়ন কি কেবল একটি শাসনের শেষ ছিল, নাকি মুক্তিকামী ...