Translate

Sunday, 25 March 2018

জলপাই রঙের কোট

মুক্তিযুদ্ধের একটি ঘটনার প্রত্যক্ষ বর্ণনা দিয়ে উপন্যাসের শুরু।
যে ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়,মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঘটে যাওয়া বাঙালিদের অনেক গোপন অথচ বীরত্বপূর্ণ কাহিনীর কথা।

যাতে আছে রজব আলীর মতো কাপুরুষ বিশ্বাসঘাতকদের নিজের দেশের সাথে বেইমানী করার অকপট বর্ণনা।অার রফিক,ইয়াসিন,ফজলদের মতো দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধাদের বীরত্বের অপূর্ব সব কাহিনী।
তারপর থেকে ফ্ল্যাশব্যাক দিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলে উপন্যাসের কাহিনী।
বাঙালির ইতিহাসের সোনালি সব অধ্যায়ের বর্ণনা মূর্ত হয়ে উঠে  একজন হতভাগা মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিচারণে।
আর গ্রামের মেটোপথে মুক্তিযুদ্ধের গল্প খুঁজতে যাওয়া একদল তরুণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে সেসব যুদ্ধদিনের কথা।

আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি,লেখকের মেদহীন গদ্যে জীবন্ত হয়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধকালে  সুবীরময় সেনের মতো সংখ্যালঘুদের উপর ইউসুফ সাহেবদের মানসিক নির্যাতনের অকথ্য সব দৃশ্যপটের করুণ বর্ণনা।
রেনুকার মতো নিঃসন্তান গৃহবধূদের সামাজিকভাবে নিগ্রহীত হওয়ার;আত্মগ্লানি নিয়ে স্বামীর বুকে মুখ লুকানোর গোপন সব না বলা গল্পের কথা।

সুবীরময় সেনের স্ত্রী বিমলার মতো অনেক নারীর স্বামীর পথ চেয়ে আপেক্ষা করার অজানা সব গল্প।লেখকের দৃশ্যকল্পে চিত্রটি ধরা পরে এভাবে-
তবু মনের ভেতর নিভু নিভু করে জ্বলে উঠে দ্বীপটি।একদিন আঁধার ক্ষয়ে ক্ষয়ে নামবে ভোর।টকটকে একটা সূর্য দেখা দেবে পুবের আকাশে।সেই সূর্যকিরণ ছড়িয়ে পড়বে চারিপাশে।বিমলা তাই আশায় বুক বাঁধেন।

আছে তার কন্যা দীপার মতো মেয়েদের অনেক গল্পকথা।যেখানে আছে একটি মেয়ের মনে স্বপ্নের পুরুষকে নিয়ে তিলে তিলে গড়ে উঠা সম্ভাবনাময় প্রেমের অসংখ্য উপাখ্যানপর্ব।
সেই সম্ভাব্য প্রেমের সম্ভাব্য পরিণতিকে লেখক চিত্রায়িত করেছেন তার সজীব-নির্বিকল্প গদ্যশৈলীর মাধ্যমে-
ডুবতে ডুবতেও দীপার চোখজুড়ে নেচে বেড়ায় অজানা স্বপ্ন এক।থেকে থেকে দুলে দুলে উঠে।হাওয়া লাগে নিভে যায়।নিভে যায় হাওয়া লাগে।ফুল ফুটে ফুল ঝরে।তবুও প্রতীক্ষা জীবনের।আশ্চর্য মানুষের এই টিকে থাকার লড়াই।
বলাই বাহুল্য পুরো উপন্যাসে আংকেলের ভূমিকায় যিনি আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনিয়েছেন;তিনি আর কেউ নন।উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র,হতভাগা মুক্তিযোদ্ধা সুজিত।সুজিত বড়ুয়া।
যে কিনা একদিন দেশকে ভালবেসে,দেশের জন্যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।কোন ধরণের প্রাপ্তির আশা ছেড়েই।
কিন্তু কখনো কখনো তার নিজের কাছে মনে হয়,মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে একটি কোট ছাড়া প্রাপ্তি হিসেবে তিনি কিছুই পান নি! তখন আপন মনে বলে উঠেন যেটা পেয়েছি সেটাই বা কম কিসের!
পাকা জলপাই রং সেই কোটের।মাঝে মাঝে যখন হতাশা বেড়ে যায়,তখন তিনি এই জলপাই রঙের কোট গায়ে হেঁটে বেড়ান পাড়ার মধ্যে।
যেটি যুদ্ধের সময় একজন পাকিস্তানি অফিসারের শরীর থেকে খুলে নিয়েছিলেন তিনি।
কোটটি গায়ে ছড়ালেই অন্যরকম একটি ভালো লাগা কাজ করে তার মধ্যে।বুকের ছাতি ফুলে উঠে তার!

"জলপাই রঙের  কোট" উপন্যাসে চট্টগ্রামের গৈরালা গ্রামের প্রেক্ষাপটে লেখক তুলে ধরেছেন সারা দেশে রক্তপিপাসু হানাদার বাহিনীদের  অবর্ণনীয় নির্যাতনের চিত্র।
একই সাথে মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যক্ষ বয়ানে উঠে আসে একাত্তরের সেইসব বীরত্বপূর্ণ আখ্যানের কথা;যেখানে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ একটি মাত্র পতাকার নিচে সমবেত হয়েছিল,
একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে।

উপন্যাসের লেখকের ভাষারীতি,গদ্যশৈলী প্রাণবন্ত।যার কারণে ঐতিহাসিক উপন্যাস হওয়া সত্ত্বেও পাঠকের কাছে বিরক্তিকর লাগবে না।
তবে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ব্যাবহার করার ক্ষেত্রে লেখক তেমন সাবলীল নন।তাছাড়া আঙ্গিক বিচারে আখ্যান বর্ণনায় লেখকের যে প্রয়াস;তা পাঠকের মনযোগ রক্ষা করতে কতটুকু সামর্থ্য হবে?
এমন একটা প্রশ্নও শেষপর্যন্ত থেকে যায়।

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা "জলপাই রঙের  কোট" উপন্যাসটি একটি দালিলিক উপন্যাস হিসেবে আমাদের বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিবে।পরিশেষে একথা বলতেই পারি।

(জলপাই রঙের কোট-রবিউল করিম মৃদুল,দেশ পাবলিকেশন্স)

Saturday, 17 March 2018

পাপ

সাব্বির জাদিদের ‘পাপ’ পড়ে উঠে মনে হলো, এটা কি পড়লাম আমি! এ আবার কেমন উপন্যাস? যে উপন্যাসের সমাজের সঙ্গে আমার সমাজকে মেলাতে পারি না। উপন্যাসের চরিত্রের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নেই। চরিত্রগুলোর নাম যদিও পরিচিত, তবু বেশ অদ্ভুত। আকাশ, বাতাসি, পাহাড়, সাগরি, নদী, বৈশাখী, পল্লবীসহ অনেক নাম। এদের আচরণও এদের নামের মতো অদ্ভুত।

ছাউনির নিচে বসবাস হলেও এরা বন-জঙ্গলে অবাধে ঘুরে বেড়ায়। বনের পশুদের সঙ্গেও এদের সখ্য রয়েছে। উপন্যাসের জায়গায় জায়গায় পশুপাখির সঙ্গে এদের অদ্ভুত অদ্ভুত আচরণ দেখে অবাক হয়েছি।
আমাদের মতো এরা দলবদ্ধভাবে বসবাস করলেও তাদের সমাজকাঠমো আমাদের চেয়ে ভিন্ন। মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক, নারী-পুরুষের যে সম্পর্ক, এদের কাছে তার একটা অন্যরকম অর্থ রয়েছে!

এটি সময় থেকে ছিটকে পড়া একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকার স্বপ্নের ঘোরে বিচরণ করার আখ্যান হলেও এর মধ্যে আমাদের সভ্য সমাজের ‘পাপ’ করার প্রবণতার দিকটি প্রকাশিত হয়েছে ভিন্নভাবে, আদিম যুগের মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে, যা যুগপৎভাবে আমাদের জানান দেয়, মানুষের পদস্খলনের পুনঃপৌনিকতার, বেঁচে থাকার আশ্চর্য সব লড়াইয়ের।

‘কাম’ মানুষের স্বভাবজাত একটি মনোদৈহিক প্রবৃত্তির নাম।এই কামের সঙ্গে পাপের একটা সম্পর্ক আছে। উপন্যাসে এই কামকে উপজীব্য করে অনেক ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে। যার মধ্যে নর-নারীর পরস্পরকে কাছে পাওয়ার যে বাসনা, তা মূর্ত হয়ে ওঠে।

অজ্ঞতা, কল্পনা ও ভয়ভীতি থেকে আদিকালে মানুষ কিভাবে ধর্মের প্রতি ঝুঁকেছে, আর কিছু মানুষ কিভাবে তার প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে, তারই একটা ধারণা পাওয়া যায় এই উপন্যাসের শেষের দিকে। যেখানে দেখা যায়, প্রাত্যহিক জীবনে ঘটে যাওয়া একটি সাধারণ চুরির ঘটনা থেকে কিভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের নামে একটি জনপদের মানুষেরা দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে, কিভাবে রক্তপিপাসু হয়ে ওঠে তারই একটি চিত্র।

সিনেমার মতো এই উপন্যাস শুরু হয়ে শেষ হয়েছে শ্বাসরুদ্ধকর এক অবিশ্বাস্য ঘটনার মধ্য দিয়ে। কল্পনার মাধুরী মিশিয়ে পাপের মৌলিক ধারণা থেকে মানুষ ও ফেরেশতার একইসঙ্গে বসবাসের যে জগৎ রচনা করেছেন লেখক, তার মধ্যে একবার ঢুকলে শেষ না করে বের হওয়া যায় না। এক ধরনের ঘোর লাগা কাজ করে।

এখানে ফেরেশতা-বিষয়ক যে ধারণা ব্যবহার করা হয়েছে, সেটাকে ইসলাম ধর্ম থেকে নেওয়া হলেও এ ধর্মের ফেরেশতাদের সঙ্গে এই উপন্যাসের চরিত্রদের শারীরিক কিংবা আচরণগত কোনো মিল নেই।

উপন্যাসের লেখকের গদ্যশৈলী সহজ-সরল, প্রাণবন্ত। শাব্দিক-ভাষিক কিংবা বর্ণনাগত কোনো জটিলতাও নেই।একনাগাড়ে পড়ে শেষ করে ফেলা যায় এমন একটি উপন্যাস।

(পাপ-সাব্বির জাদিদ,ঐতিহ্য)


 

বি:দ্র: রিভিউটি 'চিন্তাসূত্রে' প্রকাশিত।
লিংক:-http://www.chintasutra.com/2018/03/%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%aa-%e0%a6%b8%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9c-%e0%a6%a7%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%af%e0%a7%81%e0%a6%97%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%9a%e0%a6%bf%e0%a6%a4/

স্মৃতির কঙ্কাল ও জুলাইয়ের ভূত : এক অন্তর্বীক্ষণ

১. এক বছর পেরিয়ে গেল, অথচ আমার ফেসবুকের সময়রেখা যেন থমকে আছে এক অদৃশ্য বিন্দুতে। হাসিনার পলায়ন কি কেবল একটি শাসনের শেষ ছিল, নাকি মুক্তিকামী ...