Translate

Tuesday, 5 August 2025

স্মৃতির কঙ্কাল ও জুলাইয়ের ভূত : এক অন্তর্বীক্ষণ



১.
এক বছর পেরিয়ে গেল, অথচ আমার ফেসবুকের সময়রেখা যেন থমকে আছে এক অদৃশ্য বিন্দুতে। হাসিনার পলায়ন কি কেবল একটি শাসনের শেষ ছিল, নাকি মুক্তিকামী মানুষদের ভেতরকার হারিয়ে যাওয়া বিচ্ছিন্ন সংযোগগুলো জোড়া লাগার এক নতুন শুরু? উচ্ছল-উশৃংখল-গতিহারা সেই এনিলিং পর্ব দেখার অভিজ্ঞতা সর্বক্ষেত্রে সুখকর ছিলো না যদিও; তৈরি হয়েছিলো এক আনন্দদায়ক অস্বস্তি (নাকি অস্বস্তিদায়ক আনন্দ)। কিন্তু এতোদিন পর, নিপীড়িত-নিষ্পেষিত জনগণের ‘স্বাধীনতার সুখ’ কেবলই কিছু শব্দে-বাক্যে কিম্বা আচারসর্বস্বতায় পর্যবসিত হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে!

২.
গত বছরের এই সময়ে দেশ ও দশের কী অবস্থা ছিল, মনে করার চেষ্টা করি; কিন্তু বিস্ময়করভাবে, পরিবারের বাইরের কারো মুখ, কোনো ঘটনা বা স্মারক আর সেভাবে মনে পড়ে না। স্মৃতির কঙ্কালগুলো হাতড়ে বেড়াই, কিন্তু পরিচিত মুখ, ঘটনা, এমনকি একটি কোলাহলও আজ খুঁজে পাই না। প্রশ্ন জাগে—আমার মস্তিষ্ক কি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে দিনদিন? যেখানে ছোটবেলা থেকেই বিশেষ বিদ্যাভ্যাস-এর মাধ্যমে আমার ব্রেইন তথ্য ধরে রাখতে দারুণভাবে অভ্যস্ত, সেখানে আজকে কেন এই অদ্ভুত শূন্যতা?

জুলাইয়ের সেই উত্তাল বাতাস এখন স্তিমিত, কিন্তু তার ভূত যেন আজও তাড়া করে ফেরে আমার চিন্তার অলিন্দে। এই ব্যক্তিগত পরিবর্তনকেই হয়তো ইউয়ান ইয়াং তাঁর ‘প্রাইভেট রেভোলিউশনস’ বইয়ে বিবৃত করেছেন এভাবে—যখন বড় পরিসরের রাজনৈতিক বা সামাজিক অস্থিরতা ঘটে, তখন তার ছাপ পড়ে ব্যক্তিগত জীবনে, মানুষজন নিজেদের অজান্তেই এক ধরনের অভ্যন্তরীণ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যায়। সার্বিককভাবে নীরব হলেও ভেতরে ভেতরে প্রভূত পরিবর্তন ঘটায়। এই পরিবর্তনই কি আমার মস্তিষ্কের সিন্যাপটিক প্লাসটিসিটি-কে কমিয়ে দিচ্ছে? স্মৃতির সঞ্চয় কমে যাওয়া, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক (নাকি ধর্মীয়) বিরাজমান নৈরাজ্যই কি এর কারণ, যা আমার আত্মপরিচয়কে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করছে? প্রশ্ন অনেক, কিন্তু উত্তর আমার জানার পরিধির বাইরে অবস্থান করে, বর্তমানের ঘটনাপ্রবাহ আমাকে অন্য স্রোতে টেনে নেয়।

এই স্মৃতিভ্রংশতা কি এক ধরনের আত্মরক্ষা, নাকি এটিই বর্তমান উত্তর-সত্য/Post-truth সমাজের এক অনিবার্য পরিণতি, যেখানে সত্যের কোনো একক ব্যাখ্যা নেই? একসময় যা বস্তুনিষ্ঠতা/Objectivity নামক ধারণার মাধ্যমে বাস্তবতার একটি অভিন্ন বোঝাপড়া দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিত, আজ সেই ধারণাই যেন ভেঙে পড়েছে, আর আমাদের ধারণার জগৎকে গ্রাস করেছে বহুধা বিভক্ত সত্যের খণ্ডচিত্র।

৩.
জুলাইয়ের সেই দিনগুলোতে, যখন আমার চারপাশের পৃথিবী আক্ষরিক অর্থেই আমার দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছিল, তখন আমি নিজেই কিছু কথা লিখেছিলাম ছোট্ট পরিসরে, ফেসবুকে।

ফেসবুকীয় নিষ্ক্রিয়তা সময়ের পরিক্রমায় আমার ডিজিটাল অভ্যাসে পরিণত হয়ে উঠেছিলো ততোদিনে। এটিকে গভীরতর এক মানসিক বিচ্ছিন্নতার লক্ষণ হিসেবে শ্রেণিবিভক্ত করা গেলেও জুলাইয়ের ঘটনাবলী আমাকে কোনোভাবেই মননগত বিচ্ছিন্নবাদী হতে দেয়নি।
আর ব্যক্তিগত যাপনের বিবিধ বিপর্যয় সত্ত্বেও জুলাই ২০২৪-এর ‘লাল জুলাই’কে আমি কোনোভাবেই বিস্মৃত হতে দিতে চাই না। কারণ এই ঘটনা আমার কাছে কেবল একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং বিদ্যমান বাস্তবতায় এটি ছিল একটি সামাজিক ট্র্যাজেডি। আমি জানার চেষ্টা করি, আমার সহনাগরিকরা কীভাবে এই ঘটনাকে স্মরণ করছে, বা কেন তারা একে বিস্মৃত হতে চাইছে। বিশেষ করে শহুরে শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মত-অভিমত, তাদের রুচি-অভিরুচি এবং ডিজিটাল পরিসরের এদের নানাবিধ কার্যকলাপ আমাকে নানাভাবে তাড়িত করে। তারা কি দ্রুত এই ঘটনাকে ভুলে যেতে চাইছে, নাকি তাদের নীরবতা এক ভিন্ন ধরনের প্রতিরোধের ইঙ্গিত?

পল লিঞ্চের ‘প্রফেট সং’ উপন্যাসের একটি বাক্য আমার মনে তীব্রভাবে অনুরণিত হয়— “পৃথিবীর সমাপ্তি সবসময় একটি স্থানীয় ঘটনা, এটি তোমার দেশে আসে এবং তোমার শহরে যায় এবং তোমার বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে আর অন্যদের কাছে তা হয়ে থাকে কেবলই এক দূরবর্তী সতর্কতা, সংবাদের একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন, লোককথায় রূপান্তরিত হওয়া ঘটনার এক প্রতিধ্বনি।”
জুলাইয়ের ‘শেষ’টা আমার দরজায় কড়া নেড়েছিল, কিন্তু অনেকের কাছেই তা ছিল কেবলই এক দূরবর্তী সতর্কতা, সংবাদের একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন, লোককথায় রূপান্তরিত হওয়া ঘটনার এক প্রতিধ্বনি!

আর আমার কাছে যেটা সবচেয়ে অতি আশ্চর্যের বিষয় ছিল—তা হলো, জুলাইয়ের পর সমাজশরীর দ্রুত বিভাজিত হয়ে গেল। জুলাইপরবর্তীতে সমাজের এই দ্রুত বিভাজন এবং একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস, যা লিঞ্চের কথারই প্রতিচ্ছবি। মানুষগুলো যেন রাতারাতি ভিন্ন ভিন্ন শিবিরে ভাগ হয়ে গেল। যারা একসময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছিল, তারাই আজ একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখছে। ফেসবুকের ফিডগুলো হঠাৎ করেই যেন দুটি ভিন্ন বিশ্বের গল্প বলতে শুরু করল—একদল উদযাপন করছে বিজয়, আরেকদল শোকার্ত-উদ্ভ্রান্ত তাদের হারে। এই বিভাজন শুধু রাজনীতিতে নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে, এমনকি ব্যক্তিগত সম্পর্কেও এর ছাপ পড়ল। অরওয়েলের ‘১৯৮৪’-এর মতো, সত্য যেন প্রতিটি পক্ষের নিজস্ব বয়ানে বদলে যাচ্ছিল, এবং গণস্মৃতিকে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলার এক নীরব সংগ্রাম চলছিল। এই পরিবর্তন আমাকে বিমূঢ় করে তোলে, কারণ আমি কোনো নির্দিষ্ট শিবিরের অংশ হতে পারিনি, বা হয়তো চাইনি। কামু তাঁর ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’-এ দেখিয়েছেন, মের্সো জগতের অযৌক্তিকতার মুখে নির্বিকার থাকে, নিজের মতো করে। আমি আজ নিজেকে সেই মের্সোর মতোই দেখি—চারপাশের আলোড়ন আমাকে আর স্পর্শ করে না, যেন আমি এক দূরবর্তী পর্যবেক্ষক!

৪.
বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাকে এক গভীর আত্মপরিচয়ের সংকটে ফেলেছে। ইন্টেরিম গভর্নমেন্টের হম্বিতম্বি, বিএনপির নির্বাচনি জম্বিপনা, জলপাই রঙের কোটের বাসিন্দাদের নানা দেনদরবার কিম্বা জামাত-এনসিপির বিবিধ হঠকারিতা—এই সব পক্ষই যেন অসদিচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নিজস্ব সত্যের ধ্বজা উড়িয়ে চলেছে। কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’ উপন্যাসের জোসেফ কে-র মতো, আমি যেন এক অবোধ্য বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে আটকা পড়েছি, যেখানে আমার অপরাধ অজানা এবং বিচারক অদৃশ্য।

ইসলামপছন্দ ‘তৌহিদি জনতা’ কিংবা নাপছন্দ ‘প্রগতিবাদী’ চরমপন্থীদের—এই সব মেরুর মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে ফিরি। তবে ‘ইসলামপছন্দ’ অংশের দিকে তাকালে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য দেখি। ইসলামের নিজস্ব যে এক সমৃদ্ধ বৌদ্ধিক ইতিহাস ছিল, যেখানে ইমান-আমল, তাহজিব-তামাদ্দুন; একইসঙ্গে দর্শন, ইজতিহাদ এবং প্রজ্ঞার নিরন্তর চর্চা ছিল, আজ সেখানে তাদের অনেক ‘প্রতিনিধি’র মধ্যে সেই উদার ও অনুসন্ধিৎসু মানসিকতার অনুপস্থিতি আমাকে পীড়া দেয়। অথচ চিন্তাগত রক্ষণশীলতা/বিচ্ছিন্নতাবাদের চর্চায় ইসলাম কখনোই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এই ধর্মমত ছিল যাবতীয় জ্ঞান ও যুক্তির বাতিঘর, একসময়ে। কিন্তু আধুনিক কালের কিছু ‘ধর্মাশ্রয়ী’ লোকদের সংকীর্ণ মনোভঙ্গি সেই ঐতিহাসিক জ্ঞানতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা কিম্বা প্রজ্ঞাকে চাপা দিয়ে রাখে/রাখতে চায়।

অন্যদিকে, ‘প্রগতিবাদী’ চরমপন্থীদের দিকে তাকালে দেখি, তাদের মধ্যেও একসময় সাম্য, মানবাধিকার ও বৈজ্ঞানিক যুক্তির যে ‘মহান আদর্শ’ ছিল, তা সময়ে সময়ে অসহিষ্ণু তাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা বা অনমনীয় ডগমায় পর্যবসিত হয়েছে। জনমানুষের সমস্যা থেকে দূরে সরে গিয়ে তারা কেবল কিছু নির্দিষ্ট তাত্ত্বিক বৃত্তের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। একইসাথে ফ্যাসিবাদী নৈরাজ্যের অনুকূলে এরা করেছে ইসলামপন্থীদের প্রতি দুর্দমনীয় ঘৃণার চাষ এবং তাদের দমন-পীড়নের সম্মতি উৎপাদন। দুই প্রান্তের এই ‘চরমপন্থা’ই যেন আমাকে এক কঠিন দ্বিধায় ফেলে দেয়, যেখানে সত্যের খোঁজে আমি কোনো নির্দিষ্ট আশ্রয় পাই না।

ফলত, আমি বিদ্যমান সমস্ত মতাদর্শের বাইরে ‘হকপন্থি-বাংলাদেশপন্থি আমজনতা’-র মাঝে নিজেকে খুঁজে ফিরি। কিন্তু এই ‘আমজনতা’ কি কেবল আমার একটি আদর্শিক আকাঙ্ক্ষা, নাকি এর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব আছে? এই দুই মেরুর বাইরে এক সাধারণ, নীতিবান একইসাথে দেশপ্রেমিক সত্তা খুঁজে পাওয়ার আমার এই সংগ্রাম আমাকে ক্রমশই বিচ্ছিন্ন করে তুলছে। আমি কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারি না, কারণ প্রতিটি মতাদর্শই যেন কোনো না কোনোভাবে সত্যকে বিকৃত করছে। আমার এই আত্মানুসন্ধান কি কেবলই ব্যক্তিগত? আমরা কি যে যার যার মতো করে নিজেদের মনপছন্দ মতের দিকে, পথের দিকে যাত্রা করছি না প্রতিনিয়ত? সেই অর্থে এটি কি একটি জাতির সামগ্রিক আত্মপরিচয় সংকটেরই প্রতিফলন নয়?

৫.
আমার এই সাময়িক নিষ্ক্রিয়তা, স্মৃতির বিভ্রম এবং আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের সংগ্রাম—সবই জুলাই ২০২৪ গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির এক গভীর তাত্ত্বিক ব্যঞ্জনা বহন করে, যার কোনো সহজ ঋণাত্মক ব্যাখ্যা নেই। অস্তিত্বের এই অনিশ্চয়তা আমার ভেতর এক নতুন উপলব্ধির জন্ম দিয়েছে—হয়তো কোনো একক সত্য নেই, কোনো নির্দিষ্ট আশ্রয় নেই (এখানে মহাজাগতিক সত্য/আশ্রয়-এর কথা বলছি না)। জগৎ-পরিস্থিতির যাবতীয় অযৌক্তিকতা মেনে নিয়েই হয়তো আমাদের টিকে থাকতে হয়।
এই অনিশ্চয়তার মাঝেও সংগ্রাম করে যাওয়াটাই হয়তো মানুষের নিয়তি। জুলাইয়ের ভূত হয়তো ভবিষ্যতেও আমার চিন্তার বিশাল জায়গাজুড়ে বিচরণ করবে, এই ভূতের উপস্থিতিই আমাকে মনে করিয়ে দিবে যে, বিস্মৃতি নয়, বরং প্রশ্ন করা এবং নিজের ‘সত্য’কে খুঁজে ফেরাই এই অস্থির সময়ে একমাত্র পথ। ‘ক্রসিং দ্যা বর্ডারস এন্ড ব্লারিং বাউন্ডারিজ’ এর এই যুগে, আমার এই অনুসন্ধান কেবল স্মৃতির ঝনঝনানি নয়, বরং এর মাধ্যমে আমি সীমা-সুরক্ষার ধারণাকে অতিক্রম করে এক বৃহত্তর জাগতিক ‘সত্যে’র সন্ধান করছি।
এটি এক বিচিত্র ঝাঁজ-রঙ-গন্ধ-স্বাদ-সংবলিত অভিজ্ঞতা, যা আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে—হয়তো এই শূন্যতার গভীরে লুকিয়ে আছে এক নতুন আলো, যা একদিন আমজনতার সম্মিলিত কণ্ঠস্বর হয়ে উঠবে!

করুণানিধান দয়ার আধার মহান আল্লাহ সহায়...

Thursday, 12 June 2025

লেখকের অভিজ্ঞতা ও শিল্পের পক্ষপাত : সৃষ্টির এক অনিবার্য শর্ত

Illustration : fast-ink-y43tNhAVDNs-unsplash

শিল্পীর সৃষ্টি, সে হোক কলমের আঁচড়ে সাহিত্য, তুলির ছোঁয়ায় চিত্রকর্ম, বা সুরের মূর্ছনায় সঙ্গীত—কোনোটাই তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবমুক্ত নয়। এটি শুধু লেখকের ক্ষেত্রে নয়, শিল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রে, এমনকি কিউরেটরদের (যেমন: শিল্প সমালোচক, সম্পাদক, গ্যালারির মালিক) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সৃষ্টির এই গভীরে প্রোথিত ব্যক্তিগত প্রভাবকে প্রায়শই পক্ষপাত হিসেবে দেখা হয়, যা সবসময় নিন্দনীয় নয়, যদি তা স্বচ্ছ হয় এবং অন্যের জন্য ক্ষতিকর না হয়।

অভিজ্ঞতা : সৃষ্টির বীজমন্ত্র

একজন লেখকের শৈশব, পারিবারিক পরিবেশ, সামাজিক প্রেক্ষাপট, শিক্ষা, ভ্রমণ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিচ্ছেদ – এই সবকিছুই তার লেখার উপকরণ। এই অভিজ্ঞতাগুলো লেখকের মস্তিষ্কে জমা হয় এবং তার ভেতরের জগতকে নির্মাণ করে। যখন তিনি লিখতে বসেন, এই ভেতরের জগতই শব্দে প্রাণ পায়। যেমন, একজন গ্রামীণ লেখকের লেখায় গ্রামের মাটির গন্ধ, প্রকৃতির রূপ, সহজ-সরল মানুষের জীবন উঠে আসে অবলীলায়। পক্ষান্তরে, শহুরে জীবনের জটিলতা, আধুনিক সম্পর্ক, বা অস্তিত্বের সংকট ফুটে ওঠে একজন নগর-কেন্দ্রিক লেখকের কলমে। এমনকি গভীর ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিও অনেক সময় শিল্পীকে এমন এক অন্তর্দৃষ্টি দেয় যা তার সৃষ্টিকে অমর করে তোলে। এই অভিজ্ঞতাগুলোই লেখকের স্বকীয় কণ্ঠস্বর তৈরি করে, যা তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে তোলে।

পক্ষপাত : সৃষ্টির অনিবার্য দিক

এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই আসে পক্ষপাত। প্রতিটি মানুষই তার নিজস্ব লেন্স দিয়ে পৃথিবীকে দেখে, যা তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস, এবং মূল্যবোধ দ্বারা গঠিত। একজন লেখক যখন কোনো চরিত্র নির্মাণ করেন বা কোনো ঘটনার বর্ণনা দেন, তখন তার নিজস্ব বিশ্বাস এবং পক্ষপাত অজান্তেই তাতে প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, একজন নারীবাদী লেখকের লেখায় নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের বিষয়টি প্রাধান্য পেতে পারে, যেখানে হয়তো একজন রক্ষণশীল লেখকের লেখায় ঐতিহ্যবাহী লিঙ্গ-ভূমিকা বেশি প্রতিফলিত হবে। এই ধরনের পক্ষপাত সব সময় নেতিবাচক নয়। বরং, এটি লেখকের অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার কাজের মৌলিকতা প্রকাশ করে। পাঠক যখন একটি লেখা পড়েন, তখন তিনি লেখকের এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অবগত থাকেন এবং সেই অনুযায়ী লেখাকে বিচার করেন।

সংবেদনশীলতা ও দায়বদ্ধতা : একটি নৈতিক প্রশ্ন

তবে, পক্ষপাতের একটি নেতিবাচক দিকও আছে। যখন এই পক্ষপাত অসংবেদনশীল হয়ে ওঠে এবং সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে, নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা বা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে, তখনই তা সমালোচিত হয়। একজন লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতা হলো, তার লেখনী যেন কারো প্রতি অন্যায় বা অসম্মানজনক না হয়। দুর্ভাগ্যবশত, সকল মানুষ সমান সংবেদনশীলতা দেখাতে পারে না। অনেক সময় অজ্ঞতা বা ব্যক্তিগত কুসংস্কার থেকে এমন লেখা তৈরি হয় যা অন্যের ক্ষতি করে।

কিউরেটরদের ক্ষেত্রেও এই পক্ষপাত স্পষ্ট। একজন সাহিত্য সমালোচক তার নিজস্ব বিচারবোধ, রুচি, এবং সাহিত্যিক মানদণ্ড দিয়ে একটি লেখাকে মূল্যায়ন করেন। তার ব্যক্তিগত পক্ষপাত একটি লেখার গ্রহণযোগ্যতা বা জনপ্রিয়তাকে প্রভাবিত করতে পারে। এই ক্ষেত্রে, কিউরেটরের দায়িত্ব হলো তার পক্ষপাত সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং যথাসম্ভব বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখার চেষ্টা করা, যদিও তা পুরোপুরি সম্ভব নাও হতে পারে।

ভারসাম্যের প্রয়োজনীয়তা

লেখকের অভিজ্ঞতা তার সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য। এটিই তার লেখাকে প্রাণবন্ত ও মৌলিক করে তোলে। আর এই অভিজ্ঞতার অনিবার্য ফলস্বরূপ জন্ম নেয় পক্ষপাত। এই পক্ষপাত দোষের নয়, যদি তা স্বচ্ছ হয় এবং ক্ষতিকর না হয়। প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পক্ষপাতকে কাজে লাগিয়ে এমন একটি সৃষ্টি তৈরি করা যা একই সাথে শক্তিশালী এবং সংবেদনশীল। একজন লেখক বা শিল্পীর জন্য এটি একটি নিরন্তর যাত্রা, যেখানে ব্যক্তিগত সত্যের প্রকাশ এবং বৃহত্তর সামাজিক দায়িত্ববোধের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়।

স্মৃতির কঙ্কাল ও জুলাইয়ের ভূত : এক অন্তর্বীক্ষণ

১. এক বছর পেরিয়ে গেল, অথচ আমার ফেসবুকের সময়রেখা যেন থমকে আছে এক অদৃশ্য বিন্দুতে। হাসিনার পলায়ন কি কেবল একটি শাসনের শেষ ছিল, নাকি মুক্তিকামী ...