এই উপন্যাস যখন পড়তে শুরু করি, তখন প্রকৃতি কেমন ছিল?
'বর্ষামঞ্জরি' পড়তে শুরু করি বৃষ্টিমুখর বিষণ্ন এক বিকেলে ।
শুধুমাত্র একটি উপন্যাস পাঠে প্রকৃতির মলিন-বিষাদগ্রস্থ এমন একটি দিনও যে এতোটা মায়াময় আর স্নিগ্ধ হয়ে উঠতে পারে, মুগ্ধতা আর পার্থিব আচ্ছন্নতার মিশেলে কোমল একটি পরিবেশের সৃষ্টি করতে পারে, সেটা ভেবে অবাক হয়েছি । মন্ত্রমুগ্ধের মতো একনাগাড়ে পুরোটা পড়ে শেষ করেছি ।
প্রচ্ছদপাঠের প্রতিক্রিয়া কী?
বইটি হাতে নেওয়ার পর প্রচ্ছদেই চোখ আটকে গিয়েছিল।নারীমূর্তি,ধনুর্বিদ,মৎস্য আর সাথে বেলী ফুলের ছবি।এগুলো দেখে প্রথমে কোন কূল-কিনারা করতে পারিনি!
মহাভারতের অর্জুনের কথা মনে পড়ে হঠাৎ ।
দ্রৌপদীর স্বয়ংবর অনুষ্ঠানে সন্ন্যাসী অর্জুনের লক্ষভ্যেদী তীর নিমেষেই যখন মৎস্যের চক্ষুকে ভেদ করে চলে যায়,চারদিক থেকে তখন হরেক রকমের ফুলের বর্ষণ শুরু হয়।নানা বর্ণের,নানা গন্ধের সেইসব ফুলের মধ্যে হয়তো বেলী ফুলও ছিল! কে জানে...
প্রচ্ছদ পড়ে এমনটি-ই মনে হয়েছিল প্রথমে,এমনকি পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্রগুলিকে জীবন্তও মনে হয়েছিল! যেনবা চোখের সামনেই।আর উপর থেকে যে বেলী ফুলের বর্ষণ।থোকা থোকা বেলী ফুল।আহা! বুঝিবা রাজকুমারী বর্ষাঞ্জলির স্বয়ংবর অনুষ্ঠানের সেই অলৌকিক বর্ষণ।
আমি কেমন পাঠক?
আমি গল্প বলতে ভালবাসি।শুনতেও ভালবাসি।যখন কোন বই পড়ি, তখন কখনো গল্প বলিয়ে রূপে কিম্বা কখনো কখনো একজন নির্বাক শ্রোতা রূপে গল্পের চরিত্রদের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করি।
উপন্যাসের কাহিনীটা কিরকম?
এবং এর মাঝামাঝি এসে কি মনে হয়েছিল?
একজন গল্পকথক।যে কিনা কোনোরকম স্বার্থ ও উদ্দেশ্য ছাড়াই গ্রামে-গঞ্জে,শহরে-মফস্বলে ঘুরে ঘুরে লোকদের শুধু গল্প শোনায়।হরেক রকম গল্প।পাওয়া আর না পাওয়ার গল্প,বলা আর না বলার গল্প।যে গল্পে মূর্ত হয়ে আমাদের নাগরিক জীবনের সফলতা আর ব্যর্থতার ইতিবৃত্ত।একই সাথে ব্যক্তি থেকে শুরু করে সামাজিক-রাজনৈতিক রাষ্ট্রীয় বিষয়াবলিও।
গল্পের আসরে এই গল্পকথকের সাথে তার শ্রোতারাও আবার সমান গুরুত্বপূর্ণ।সবাই মুক্ত-মতামত জানিয়ে নিজেরদেরকে আরো গল্পের সাথে জুড়ে দিতে চাই।সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।বিচিত্র সব মানুষের সেইসব বৈচিত্র্যপূর্ণ মন্তব্য যেনবা বহুচিন্তার মানুষদের চিন্তাগত সহাবস্থানের এক অলৌকিক ইঙ্গিত! বুঝিবা সমাজের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের শিকড়ের গভীরতার পরিমাপ! যার অন্তিম পরিণতি গল্পকথকের হাতেই লেখা হয়।
উপন্যাসের পরিণতি নিয়ে আগ্রহ কেমন ছিল?
কোন বিষয়টি আমার কাছে আশ্চর্যজনক মনে হয়েছে?
গল্পকথকের গল্পই আমার আকার্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল,অন্তত গল্পের শেষের সেই করুণ অথচ ঘোরলাগা সময়ের চিত্র অবলোকন করার আগমূহুর্ত পর্যন্ত। স্বয়ংবর অনুষ্ঠানের বিচিত্র সব মানুষের সমাগমে রাজকুমারী বর্ষাঞ্জলির সেই মহৎ প্রাণের চিকিৎসকের গলায় মালা পরানোর সম্ভাব্য পরিণতি যতটা না কাঙ্খিত ছিল,গল্পকথকের উপস্থিতি তার চেয়েও বেশি চমকপ্রদ ছিল,সেই অলৌকিক ঘটনার জন্যে নয়,বরং শেষ মূহুর্তে গিয়ে গল্পকথকের নিজেই নিজের গল্পের চরিত্র হয়ে উঠার জন্য।
লেখকের লেখার সাথে আমার বোঝাপড়া কেমন?
লেখকের এই জাদুবিস্তারি গদ্যভঙ্গির সাথে আমার পরিচয় হয় দুই-তিন বছর আগে । তাঁর উপন্যাস 'অন্য কোথাও অন্য কোনখানে'র মধ্য দিয়ে । সেই যে মোহগ্রস্থ হয়েছি, এখনো সেই মোহ কাটে নি । দিন দিন সেটা বেড়েই চলেছে ।
পাঠ শেষে তীব্র আবেগের সাথে 'বর্ষামঞ্জরি' কে জড়িয়ে ধরি। যেন সমস্ত ভালোলাগা ক্ষনিকের জন্য হলেও একাকার হয়ে যায় । আর ঘোরগ্রস্থের মতো ভাবতে থাকি, এ কেমন উপন্যাস?
কিন্তু ভাবনা শেষ হয় না ।
এই ভাবনা শেষ হওয়ার নয় । কারণ এই ভাবনা যে অসীম!
আর একে পাড়ি দেওয়ার ক্ষমতা কি আদৌ আমার আছে...
আর কিছু বলার আছে?
হুম,আছে ।
আমি মনে করি, কেউ যদি বাংলাদেশকে জানতে চাই, এদেশের মানুষকে জানতে চাই; তাহলে তার এই উপন্যাস পড়া উচিৎ!
পুনশ্চ - এটি এই উপন্যাসের সামগ্রিক মূল্যায়ন নয় ।
বই সম্পর্কে~
নাম-বর্ষামঞ্জরি
লেখক-আহমাদ মোস্তফা কামাল
প্রচ্ছদ-শাহীনুর রহমান
প্রকাশক-শুদ্ধস্বর
মূল্য- ১৮০ টাকা